ছবির এই অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্যের মসজিদটি আর নেই এখন। জানা যায়, এটি আসলে প্রথমে মসজিদ ছিল না। প্রাচীন ফিলিস্তিনের মন্দির ছিল এখানে। আর তা ছিল পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের। এরপর ৫ম শতাব্দীতে চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় এ জায়গায়। আর ৭ম শতাব্দীতে মুসলিমরা এই স্থানে নিজেদের আধিপাত্য প্রতিষ্ঠা করার পরে গড়ে তোলা হয় এই অপূর্ব সুন্দর মসজিদটি।
ইতিহাস বলে,পর্যটক ইবনে বতুতা এই মসজিদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৪শ শতাব্দীতে তিনি এখানে ভ্রমণ করতে আসেন। ১০৩৩ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প, ১২৬০ সালের মোগল আগ্রাসন, যুগে যুগে ক্রুসেডার থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার পরেও আবার পুনর্স্থাপন করা হয় এই ঐতিহাসিক মসজিদটি। তবে গত ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া এই নয়নমনোহর স্থাপত্যের মসজিদটি এখন শুধুই ছবি। এ পর্যন্ত গাজায় যতগুলো হেরিটেজ সাইট ধ্বংস হয়েছে, তার মাঝে এটি আসলে আলাদা রকমের বিশিষ্ট ছিল ফিলিস্তিনিদের কাছে।
গাজায় বেড়াতে গেলে যে কয়টি দর্শনীয় স্থানের কথা এক বাক্যে বলতেন স্থানীয় এলাকাবাসী, তার তালিকার শীর্ষের দিকেই থাকত এই ওমরি মসজিদ। এটি গাজার পুরনো নগরীর দারাজ কোয়ার্টারে অবস্থিত ছিল। বিখ্যাত প্যালেস্টাইন স্কোয়্যার ঠিক এর উত্তর পশ্চিম দিকে। প্রাচীন ওমর মুখতার সড়কের শেষ মাথা বলা যায় জায়গাটিকে। গাজার বিখ্যাত সোনাদানার মার্কেটটিও একদম কাছে। নজরকাড়া মিনারের বদৌলতে এটি চোখে পড়তো অনেক দূর থেকে।
মসজিদে নামাজের জায়গা, দরবার ও মিনার ছিল। এর স্থাপত্যে দেখা যায় বৈচিত্র্যময়তা। পশ্চিমে চার্চের আদল আছে এতে। তবে এই অঞ্চল জয় করে নেওয়ার পর মুসলিম খলিফা হজরত ওমরের সেনাপতিদের তত্বাবধানে এটিকে তৈরি করা হয়। এজন্য এটি ওমরি মসজিদ নামে পরিচিত। আব্বাসীয় যুগে আরব ভূগোলবিদ আল মুকাদ্দিসি এর স্থাপত্যশৈলি দেখে মুগ্ধ হন। এটি ছিল ৯৮৫ সালের কথা। এরপর এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে ১০৩৩ সালে ধ্বসে পড়ে এর মিনার। আর দারুণ ব্যাপার হচ্ছে এই যুগে যুগে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নির্মাণে এতে ছাপ পড়েছে সকলেরই। এজন্য এর স্থাপত্য ও অন্দরসজ্জা অনেকটা মিশ্র ঘরানার ছিল।
তবে বহুদিন ধরে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় এখানকার হিব্রু ভাষায় লেখা ইহুদিদের বিভিন্ন স্তোত্র বা মেনোরাহ মুছে ফেলা হয়।
এর নির্মাণে ইহুদিদের সাইনাগগের প্রভাবও সুস্পষ্ট। এর ওপরের থামগুলো সেকথাই বলতো। পরবর্তীতে মামলুক সুলতানরা এর মেরামত ও পুনর্নিমাণের কাজ করায় তাঁদের উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন জায়গার লিপিমালায়।
এই মসজিদটি সব মিলে ৪১০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে ছিল। সাগরপাড়ের স্যান্ডস্টোন দিয়েই তৈরি হয় এটি। এই পাথর এখানে কুরকার নামে পরিচিত। এর ভেতরে নামাজের জায়গা ছাড়াও লোক জমায়েত হতে পারে এমন দরবার আছে বিশাল। মসজিদের ফটকের ওপরে মামলুক সুলতানদের নাম লেখা নকশা দেখা যায়।
ইতালিয়ান গথিক স্টাইলের নির্মাণশৈলির ছাপ রয়েছে মসজিদের থামগুলোতে। ভেতরের দেয়ালে প্লাস্টার ও রং করা।
পশ্চিমে ক্রুসেডারদের চার্চের আদলের প্রবেশপথের দরজায় মার্বেল পাথর। মেঝেতে চকচকে টাইলস।
ছোট একটি মার্বেল পাথরের মিহরাব আছে এখানে। এতে অটোমান আমলের গভর্নর মুসা পাশার নাম লেখা। এই গ্রেট মস্ক অফ গাজা সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল এর মিনারের জন্য। নিচের দিকে এটি চারকোণা আর ওপরে অষ্টভূজাকার। এটিও পাথরের তৈরি। এই মিনারে রয়েছে ঝুলন্ত বারান্দা। একদম চূড়ার নকশা কাঠ ও নকশি টাইলসের।
শুধু যে মসজিদটির স্থাপত্যই টানত সকলকে, তা নয়। এই মসজিদটি ছিল একটি হেরিটেজ সাইট। সেই ৭ম শতাব্দী থেকে বহু সম্প্রদায় ও দেশের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটি গড়ে উঠেছিল। আর তা হয়ে উঠেছিল গাজাবাসীদের প্রাণকেন্দ্র, মিলনমেলা। ইতিহাসের পাতায় ছবি হয়ে রয়ে যাওয়া এই ওমরি মসজিদের বড় অংশ আর মিনার প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজাবাসীর কাছে এখানে সকলে মিলে নামাজ পড়া আর একে অপরের মাঝে বেঁচে থাকার শক্তি খোঁজা এখন শুধুই স্মৃতি। এমন একটি হেরিটেজ সাইট গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য সমালোচনা করা হয়েছে ইসরায়েলকে। তবে বারবার ধ্বংসস্তুপ থেকে আবার উঠে আসা ওমরি মসজিদটি আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা এবার নেই বললেই চলে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, কনভারসেশন ডট কম
ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স, উইকিপিডিয়া, ইন্সটাগ্রাম