ঢাকার খুব কাছেই দেখতে পেলাম রাঙা মানিকজোড়
শেয়ার করুন
ফলো করুন

রাঙা মানিকজোড় যখন ঢাকার আউটস্কার্টে অবস্থান করে, ভাগ্যচক্রে আমি তখন রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ছুটিতে সাভারেই অবস্থান করছিলাম। এই ছুটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় ঘুরছিল চট্টগ্রামের হাজারিখিল যাওয়ার বিষয়টি। কিন্তু অনিবার্য কারণ বশত সেটি আর হয়ে উঠল না। তারপর শরীয়তপুরে পদ্মার একটি চরে গেলেও তা খুব একটা সফল হয়নি। এর পর দিন আফতাবনগরে রুবিথ্রোটের ছবি তুলতে গিয়ে পাখিটি না পেয়ে ব্লুথ্রোটের ছবি তুলে ফেরত আসছি। অগত্যা যাব কি যাব না করতে করতে মিম ভাই আর নাইম কে নিয়ে ঢাকার জ্যাম ঠেলে চলে গেলাম কেরানীগঞ্জে।

ছবি: কাফি আল আজাদ

যেখানে রাঙা মানিকজোড় অবস্থান করছিল সেই জায়গায় ছোট বড় বেশ কয়েকটি পুকুর ও চাষাবাদের জমি রয়েছে। এর ছবি তুলতে গিয়ে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। আমরা এর লোকেশনের দিকে যেতেই দেখলাম যে চারজন বার্ডার সেদিক থেকেই ফেরত আসছে। আমাদের দেখেই তারা বলল পাখিটি উড়ে গেছে৷ উড়ে উড়ে নাকি অনেক ওপরে উঠে গেছে। এতই ওপরে উঠে গেছে যে, নিচ থেকে দেখাই যায় না। হতাশাগ্রস্ত হয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম ফিরে আসব, তখন দিয়া ভাই বললেন, চলেন ভাই গিয়ে দেখি। কিছুটা সমনে এগোতেই চোখে পড়ল এক পায়ে চমৎকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে রাঙা মানিকজোড়।

ছবি: কাফি আল আজাদ

যাই হোক, সেদিন কোন কুয়াশা ছিল না,  চমৎকার রোদ ছিল। আমি পুকুরের এক কোনায় আরামসে বসে পাখিটিকে কোনো প্রকার বিরক্ত না করে ক্লিকের পর ক্লিক করতে থাকলাম। পাখিটিও দারুণ ভাবে আমাকে সহযোগিতা করতে থাকল। নানা ভঙ্গিতে পোজ দিতে থাকল। কিন্তু কোন মাছ ধরলো না। এর এত ছবি তুলছি, তবুও মন ভরছে না। প্রায় এক/দেড় ঘন্টা মন ভরে দেখলাম আর ছবি তুললাম।

বিজ্ঞাপন

রাঙা মানিকজোড়, রঙ্গিলা বক বা সোনাজঙ্ঘা নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Painted Stork, যার দ্বিপদ নাম Mycteria leucocephala. এই নামটির আক্ষরিক অর্থ জানতে হলে, আমরা শব্দ দুটিকে ভেঙে দেখতে পারি: Mycteria শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘muktēros’ থেকে এসেছে, যার অর্থ নাক বা শুঁড়। এই ক্ষেত্রে এই পাখির লম্বা, বাঁকানো ঠোঁটের দিকে ইঙ্গিত করে। leucocephala শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দের সমন্বয়। Leukos অর্থ সাদা এবং Kephale অর্থ মাথা। সুতরাং, ‘Mycteria leucocephala’ এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘সাদা মাথাওয়ালা নাক বা ঠোঁট বিশিষ্ট পাখি’। এটি Painted Stork-এর বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে, যার মাথা সাদা এবং ঠোঁট লম্বা ও বাঁকানো। এরা বেশ বড় সাইজের জলচর পাখি।

ছবি: কাফি আল আজাদ

এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ৯৩ সেন্টিমিটার, ডানা ৫০ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২৬.৫ সেন্টিমিটার, লেজ ১৬ সেন্টিমিটার ও পা ২৪.৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩ কেজির আশপাশে। এদের মুখ ও মাথা পালকহীন হলদে-কমলা রং এর। দেহ, গলা, পিঠ ও দেহতল সাদা। ডানায় সাদা কালো ডোরা রয়েছে। বুকেও কালো ডোরা টানা রয়েছে। এর দেহের আকর্ষণীয় দিক আমার কাছে লাগে এর লেজের গোলাপি রং। এছাড়াও লালচে/হলদে গোলাপি রং এর পা এবং হলদে রং এর বিশাল ঠোঁটও এর চেহারায় বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে৷ পুরুষ ও স্ত্রী পাখি দেখতে একই রকম। এরা অল্প পানিতে হেঁটে বেড়ায় এবং বিভিন্ন জলচর প্রাণী যেমন মাছ, ব্যাঙ, চিংড়ি, কাঁকড়া, জলজ পোকামাকড় ও ছোট সরীসৃপ ধরে খায়। বিশ্রামের সময় এরা এক পা ভাঁজ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাসা বানায় জলাশয়ের ধারের গাছে। এদের বাসা এদের দেহের আকৃতির সঙ্গে মানানসই। অর্থাৎ শুকনা সরু ডাল দিয়ে এরা বিশাল আকৃতির বাসা বানায়। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী পাখি ৩ থেকে ৫ টি ডিম দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ২৮ থেকে ৩২ দিন।

ছবি: কাফি আল আজাদ

একসময় আমাদের দেশে পাখিটি বেশ ভালো সংখ্যায় দেখা গেলেও এখন এটি আর তেমন দেখা যায় না। আমারদের সাধারণ সমস্যা হচ্ছে কোন বন্য প্রাণী বা পাখি দেখলে এদেরকে ধরতে হবে বা মারতে হবে, অথবা খেয়ে দেখতে হবে। আগে তো ফাঁদ দিয়ে মানুষ পাখি ধরতো এবং এয়ারগান ও গুলতি দিয়ে শিকার করতই, সেই সঙ্গে হালে যোগ হয়েছে বিষটোপ। বিষটোপ খেয়ে মারা যাওয়া পাখির মাংস খেতে আবার বিশেষ অঞ্চলের হোটেলগুলোতে মানুষের ঢল নামছে। মানুষের লোভে পড়ে এরা হারিয়ে যেতে বসেছে। সারা বিশ্বে এদের মোট সংখ্যা ১০ থেকে ১৭ হাজার। IUCN এদের প্রায় সংকটাপন্ন বলে চিহ্নিত করেছে। যার যার জায়গা থেকে নিজে সচেতন না হলে এবং আশপাশের লোকজনকে সচেতন না করলে একসময় হয়তো এই অনিন্দ্য সুন্দর পাখিটি হারিয়েই যাবে।

লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও বার্ড ফটোগ্রাফার

বিজ্ঞাপন
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১: ০০
বিজ্ঞাপন