
বাংলাদেশের শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননশিল্প ইউনেসকোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ (আইসিএইচ) অব হিউম্যানিটির প্রতিনিধি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের ২০তম অধিবেশনে ২০২৫ সালের চক্রের মূল্যায়ন শেষে এই স্বীকৃতি ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা আসমা ফেরদৌসি।

এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ইউনেসকোয় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি খন্দকার মোহাম্মদ তালহা, দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ ও ফ্রান্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা মো. ওয়ালিদ বিন কাশেম। টাঙ্গাইল শাড়ি বুননশিল্প বাংলাদেশের ষষ্ঠ আইসিএইচ উপাদান। এর আগে তালিকাভুক্ত হয়েছে বাউলসংগীত (২০০৮), জামদানি বয়ন (২০১৩), মঙ্গল শোভাযাত্রা (২০১৬), শীতলপাটি বয়ন (২০১৭) এবং রিকশা ও রিকশা পেইন্টিং (২০২৩)।
২০২৪ সালে ২০০৩ কনভেনশনের আর্টিকেল–১২ অনুযায়ী টাঙ্গাইল শাড়ি বুননশিল্পকে জাতীয় বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনলাইন ইনভেন্টরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করা নমিনেশন ফাইলটি ইউনেসকোতে পাঠানো হয়। প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর এ বছরের এপ্রিলে পুনরায় জমা দেওয়া হয় বলে জানান আসমা ফেরদৌসি।

টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রজন্মান্তরে হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বুননের এই কৌশল কেবল একটি কারুশিল্প নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তাঁতিদের শ্রম, নকশা ও রঙের সৃজনশীলতা এবং সুতা প্রস্তুতকরণের সূক্ষ্ম দক্ষতার সমন্বয়ে টাঙ্গাইল শাড়ির অনন্য শিল্পরূপ তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘এটি বাংলাদেশের বস্ত্র–ঐতিহ্যের অপরিহার্য অংশ এবং আমাদের হ্যান্ডলুম শিল্পের শিকড়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।’
২০১৩ সালে জামদানি বয়নশিল্প ইউনেসকোর আইসিএইচের তালিকায় যুক্ত হওয়ার পর ২০২৬ সালে তা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) মর্যাদা পায়। এবার টাঙ্গাইল শাড়ির ক্ষেত্রে উল্টো যাত্রা—২০২৩ সালে জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এবার এল ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে আয়োজিত হয় ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তসরকারি কমিটির চূড়ান্ত সভা। লিভিং হেরিটেজ হিসেবে ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় নিবন্ধনের জন্য এ বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৫৪টি নমিনেশন ফাইল উপস্থাপিত হয়। বর্তমানে ১৫০টি দেশের ৭৫০টির বেশি জীবন্ত ঐতিহ্য আইসিএইচের তালিকায় রয়েছে।
ইউনেসকোর ২০০৩ কনভেনশন অনুযায়ী, আইসিএইচ হলো কোনো সম্প্রদায়ের এমন প্রথা, দক্ষতা, জ্ঞান ও সামাজিক আচরণ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তি গড়ে তোলে। এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে ঐতিহ্য শনাক্ত, নথিভুক্ত, সংরক্ষণ ও প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ২০০৯ সালে এতে যুক্ত হয়।
আইসিএইচের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব বহুমাত্রিক। প্রথমত, এটি বৈশ্বিক স্বীকৃতি এনে দেয়, যার মাধ্যমে ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক মূল্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়ত, এতে সম্প্রদায় ও শিল্পীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তৃতীয়ত, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বয়ে সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ বাড়ে। তা ছাড়া অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও তৈরি হয়—বাজার সম্প্রসারণ, পর্যটন, ব্র্যান্ডিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আইসিএইচের তালিকায় যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ ও সুসংগঠিত পদ্ধতি। নমিনেশন জমা, ঐতিহ্যদাতাদের সম্মতি, সংরক্ষণ পরিকল্পনা, ভিডিও–ফটো নথি ও ইভালুয়েশন বডির পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয় আন্তসরকারি কমিটি। তালিকাভুক্তির পর সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে সংরক্ষণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়।

তবে স্বীকৃতি কোনো সরাসরি আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করে না। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. মাসুদ ইমরান মনে করেন, জিআই আইন মেনে টাঙ্গাইল শাড়ির ট্রেডমার্ক সুরক্ষা জরুরি, না হলে স্বীকৃতির সুফল পুরোপুরি পাওয়া কঠিন। অন্যদিকে টাঙ্গাইল তাঁতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জানান, এই স্বীকৃতি ঐতিহ্য রক্ষায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে এবং তরুণ প্রজন্মকে তাঁতশিল্পে আগ্রহী করবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে, যা এই শিল্পের পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত বলে মনে করেন তিনি।
টাঙ্গাইল অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী বসাক ও জোলা সম্প্রদায়ের দীর্ঘ ইতিহাস টাঙ্গাইল বয়ন–ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। ইউনেসকোকে পাঠানো নমিনেশন ফাইলেও এই সম্প্রদায়ের অবদান উল্লেখ রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হ্যান্ডলুম শিল্পের টিকে থাকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যন্ত্রচালিত তাঁতের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। বয়ন এলাকাজুড়ে যন্ত্রতাঁত নিয়ন্ত্রণ এই ঐতিহ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে
টাঙ্গাইল শাড়ি বুননশিল্পের ইউনেসকোর স্বীকৃতি বাংলাদেশের বস্ত্র–ঐতিহ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। জামদানি–পরবর্তী এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের আরেক সমৃদ্ধ বয়ন–ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করাবে, এটুকু নিশ্চিত।
ছবি: হাল ফ্যাশন, প্রথম আলো ও আসমা ফেরদৌসি