আমি ছোটবেলায় মনে করতাম, আমি পরি। উড়ে উড়ে মায়ের কোলে এসে পড়েছি। তারপর ডানা দুটি অদৃশ্য হয়ে গেছে! কিন্তু রয়ে গেছে ঠিকই। আমার দুধসাদা ধবধবে ডানা দুটি শুধু আমিই দেখতে পেতাম। খুব অস্বস্তি নিয়ে বলি, এখনো পাই। কিন্তু সব সময় না।
ছোটবেলায় আমার কোনো খেলনা ছিল না। শুধু ছিল অনেক অনেক বই। আমি পুরোদমে বই পড়তে শুরু করেছি বেশ ছোট বয়সে। আমার জন্মের পর আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহতে চলে যাই, যখন আমার বয়স সাড়ে তিন মাস। মা আর আমি ছিলাম দুজন দুজনার। কারণ মায়ের ভাষ্যমতে, আমার পিএইচডিরত বাবা তখন বইয়ের স্তূপে হাবুডুবু খেতে গিয়ে আমাদের ভুলেই গিয়েছিলেন। মায়ের সার্বক্ষণিক দায়িত্বের একটা ছিল আমাকে গল্প বলা। ভয়াবহ গল্পখেকো আমি নাকি তাঁকে ভীষণ নাজেহাল করতাম নতুন গল্পের চাহিদায়। তার ওপর উড়ে এসে জুড়ে বসল আমার ছোট বোন আর ঢকঢক করে গিলে নিল মায়ের অনেকখানি দৈনিক সময়। আমার বয়স তখন দুই। মা নিরুপায় হয়ে আমাকে একগাদা গল্পের বই কিনে দিয়ে বললেন, এইখানে গল্প আছে। অক্ষর নাকি চিনে গেলাম অবিশ্বাস্য দ্রুততায়! গল্পখেকোর তখন নেশা উঠেছে। এর পর থেকে আমার হালকা আবছা সব স্মৃতিই বই নিয়ে প্রায়। আমার সেই প্রথম দিককার একটা বই ছিল লিটল গোল্ডেন ফেয়ারি টেলস। নীল মলাটে আঁকা সাদা একটা পরি। হাতে তার জাদুর কাঠি। মাথায় জ্বলজ্বলে একটা তারা। নাদুসনুদুস পরিটা ফিক করে হেসে আছে গোলাপি ঠোঁটে। এত কিছু মনে নেই। বইটা কোলে নিয়ে ফোকলা হাসি দিয়ে একটা ছবি আছে আমার। সেটাতেই দেখেছি এত খুঁটিনাটি। পরিটাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। এখনো বাসি। আমার পরি নিয়ে ফ্যান্টাসির শুরু মনে হয় তখনই।
এর পর থেকে যত বইতে যত পরি পেয়েছি, সবাই মনে দাগ কেটেছে খুব। আর নিজেকে পরি ভাবতাম আমি চরম বিশ্বাস নিয়ে। পরি ছাড়া রূপকথা কিন্তু খুব কম। আর ডানা থাকার ব্যাপারটা আসলেই রোমাঞ্চকর। রাজকন্যাও ভাবতে পারতাম নিজেকে। কিন্তু সে তো একটু পরপর বিপদে পড়ে। আর রাজপুত্রের জন্য হাপিত্যেশ করে যে কখন সে এসে তাকে বাঁচাবে। আর পরি নিজেই উড়তে পারে, কারও ওপর নির্ভর করে না। তাই সব মিলিয়ে পরি হওয়াটাই ভালো মনে হয়েছিল। আর পরি হওয়ার আরেকটি অসাধারণ ব্যাপার হলো, পরিরা সবার ইচ্ছা পূরণ করে। এটা আমাকে ছুঁয়েছিল খুব বেশি।
বিশ্বের এমন কোনো দেশ বা জাতি নেই, যেখানকার রূপকথায় পরির অস্তিত্ব নেই। ইতিহাস বলে, সেই ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের ইতালিয়ান রূপকথায় পরির গল্প আছে। হয়তো তার আগেও ছিল, কিন্তু রেকর্ড নেই। আর ছাপার অক্ষরে পরিকে নিয়ে আসেন ফরাসি লেখক চার্লস পেরোঁ। সেটা ১৬০০ শতাব্দীতে। ১৯৯৮ সালে মার্কিন শিল্পী জেসিকা গ্যালব্রেথ প্রথম ২৪ জুন আন্তর্জাতিক পরি দিবসের প্রস্তাব রাখেন। এরপর ধীরে ধীরে পরিপ্রেমী বিশ্ববাসী এ ধারণাকে আপন করে নেন। এ দিনে নানা দেশে রূপকথার গল্প আর শিল্পে পরির ভূমিকাকে উদ্যাপন করা হয়। পরিকে না ভালোবাসে!
পাশ্চাত্যের রূপকথার বইয়ের পরিগুলো দেখতে খুব মিষ্টি। নীল, সাদা নয়তো গোলাপি পোশাক পরা। খুব হাসিখুশি তারা। বিদেশি পরির আছে নানা রূপ। সবাই যে অপরূপা সুন্দরী, তরুণী বা কিশোরী, তা কিন্তু নয়। ফেয়ারি গডমাদারের কথাই ধরা যাক। সিন্ডারেলার গল্পে তিনিই উদ্ধার করেছিলেন সেই বেচারিকে। টুথ ফেয়ারির ধারণা খুব পুরোনো নয়। পশ্চিমা দেশে দুধের দাঁত পড়ে গেলে ইঁদুরের গর্তে না ফেলে বালিশের নিচে রেখে ঘুমায় সেখানকার শিশুরা। আর সকালে উঠে দেখে বালিশের নিচে এক টাকার কয়েন পড়ে আছে চকচকে। দাঁত নিয়ে গেছে টুথ ফেয়ারি। আসলে যে তাদের মা সেই টুথ ফেয়ারি, তখন সেটা তারা বুঝতে পারে না। রূপকথার গল্প পিটার প্যানের ছোট পরি টিংকারবেলই মনে হয় সবচেয়ে প্রিয় আমার।
ছায়ার মতো থাকে পিটারের পাশে। পিটারকে রক্ষা করে, পথ দেখায়। কিন্তু তার বিনিময়ে কিছুই চায় না। এমন অনেক টিংকারবেল আমাদের জীবনে আছে, যাদেরকে আমরা মূল্য দিই না। সব পরি যে ভালো, তা কিন্তু নয়। স্লিপিং বিউটি রূপকথার দুষ্টু পরির কথাই ধরা যাক। তবে ম্যালিফিসেন্ট যে পুরোপুরি খারাপ পরি, সে কথাও বলা যাবে না।
পাঁচ বছর বয়সে মার্কিন মুলুক থেকে বাংলাদেশে আসার পর রূপকথার বইয়ের মলাটে পরির আরেক রূপ দেখতে পেলাম। পরিরা এখানে শাড়ি পরে। চুড়ি, টিপ আর টিকলি পরে। তারা আবার খিলখিল করে হাসে না। মুখটিপে হাসে। আর মুখটা কী যে সুন্দর! একদম মায়ের মতো।
তবে বড় হতে হতে খেয়াল করলাম, কেউ খুব ফর্সা হলে বা তার মুখটা একেবারে সিনেমার নায়িকাদের মতো হলে তাকে সবাই পরির মতো সুন্দর বলে। পানপাতার মতো মুখ, টিকলো নাক, পটলচেরা চোখ, সরু ঠোঁট, সুডৌল চিবুক আর টসটসে গাল থাকে তাদের। বিউটি স্ট্যান্ডার্ডে এই পরির মতো সুন্দর ব্যাপারটা বেশ উচ্চ মর্যাদার, সেটা বুঝতে শিখলাম।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমি আয়নায় যে পরিটা দেখতাম, সে আমি যা পরি, তাই পরে। আমি যেমন, সে দেখতে খুব তেমনই সাদামাটা, শ্যামলা আর ঢ্যাঙা। পরিটার ডানা না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে সে পরি। কিন্তু ডানা তো আছেই। তাহলে সে পরি না হয়ে যায় কোথায়! ধবধবে সাদা ডানা দুটি আর কেউ কেন যে দেখতে পায় না কে জানে! আমি তো পাই। যখন আশপাশে কেউ থাকেন, তখনই পাই। কাশফুল আর দুর্বাঘাসের মতো নরম ডানা দুটি মাঝেমধ্যেই সুড়সুড়ি দেয় ঘাড়ের কাছে। চুলের আশপাশে। কপালে আর নাকমুখে।
আমাদের আশপাশে এমন অনেক পরি আছে, যারা আরেকজনের বা সমাজের চোখে পরি না হলেও নিজের কাছে সে খুব সুন্দর, একেবারে পরির মতো। আর সে সুন্দর তার প্রেমিকের চোখে। আমাদের সমাজে আরেকটি কথা প্রচলিত আছে। ডানাকাটা পরি। ডানা কেটে দিলে পরি আর পরি থাকে কি? আমরা পরিদের ডানা কেটে দেই। তাদেরকে উড়তে দেই না। বন্দী করে ফেলি। অথচ এই পরিদেরকে উড়তে দিলে তারা বিদ্যা, বুদ্ধি, যোগ্যতা দিয়ে আকাশ নয়, মহাকাশে পৌঁছে যেতে পারে। তবুও পরি তথা নারীদের ডানা কাটা হয় ঘরে ঘরে। যাতে তারা উড়তে না পারে।
পরির ইচ্ছাপূরণ করার ক্ষমতাটাই আসলে পরিকে পরি করে তোলে। আর উড়তে পারার শক্তি। ডানাগুলো দৃশ্যমান না হলেও আমরা যেন আমাদের আশপাশের পরিদেরকে চিনতে শিখি। তাদের ডানা না কেটে যেন উড়তে দেই মুক্তভাবে।
সেই পরি কারও কন্যা, কারও প্রিয়তমা আর কারও মা। কিন্তু সে নিজে এক স্বাধীন সত্ত্বা। তাকে একটু পড়াশোনা করা, নিজের পছন্দমতো সাজপোশাক পরা, নিজের শখ পূরণের সুযোগ করে দিলে সে সত্যিকারের পরি হয়ে যায়। তবে আজকের দিনের পরিকে হতে হবে সাহসী আর আপন শক্তিতে উজ্জ্বল। নিজের ডানা নিজেই চিনে নিতে হবে, ওড়ার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। শুধু তার ডানা যেন না কেটে দেয় কেউ, পরি দিবসে এটুকুই চাওয়া।
ছবি: পেকজেলস ডট কম