বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে ইলন মাস্কের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক। দারুণ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের গ্রাহকেরা আজ থেকেই অর্ডার করতে পারবেন।
শ্রীলঙ্কার পরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বৈশ্বিক এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করছে। যাত্রা শুরুর পর থেকেই আসলে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগের জগতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
ইলন মাস্কের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট প্রোভাইডার সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানি আমরা। কিন্তু এর আরও কিছু অজানা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলোর কথা অনেকেই জানে না। এই ফিচারগুলোর সবই যে খুব সিরিয়াস, তা নয় কিন্তু। টেক জিনিয়াস ইলন মাস্কের মতোই অদ্ভুত এর কোনো কোনোটি। আবার ইউনিকও। চলুন তবে বহুলপ্রতীক্ষিত স্টারলিংকের এমন ১০টি অজানা ফিচার দেখে নিই।
১. 'মেড অন আর্থ বাই হিউম্যান' বার্তাসহ ইস্টার এগ
স্টারলিঙ্ক ডিশের জটিল সার্কিটের মধ্যে লুকানো একটি বার্তা রয়েছে: 'Made on Earth by humans' (মানুষ দ্বারা পৃথিবীতে নির্মিত)। এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ভি ওয়ান স্টারলিঙ্ক ডিশ ভেঙে ফেলার সময়। এই বাক্যটি কিন্তু টেসলা গাড়ি আর মহাকাশে পাঠানো টেসলা রোডস্টারের সার্কিট বোর্ডেও দেখা যায়। ইলন মাস্কের স্পেসএক্স পৃথিবীর বাইরেও মানুষের কীর্তির কথা জানাতে চায় অন্য গ্রহের বাসিন্দাদের। আর সেই প্রেরণা থেকেই এই মেসেজ।
২. অরবিটাল ট্রান্সফার এলিপস লোগো
স্টারলিঙ্কের লোগো, বিশেষ করে জেন টু ও জেন থ্রি ওয়াইফাই রাউটারে দেখা যাওয়া লোগোটি কিন্তু নিছক ডিজাইন নয়। এটি আসলে হউম্যান ট্রান্সফার অরবিটের প্রতীক—যা মহাকাশে গ্রহ থেকে গ্রহে ভ্রমণের সবচেয়ে কার্যকর কক্ষপথ।এই লোগোতে তিনটি সংযুক্ত বৃত্ত রয়েছে: ছোটটি পৃথিবী, বড়টি মঙ্গল, আর মাঝেরটি পৃথিবী থেকে মঙ্গলে যাওয়ার ট্রান্সফার অরবিট বোঝায়। এটি স্টারলিংকের গ্লোবাল সংযোগ আর স্পেসএক্সের আন্তঃগ্রহ ভ্রমণ নিয়ে যে উচ্চাভিলাষী চিন্তা আছে, তারই প্রকাশ।
৩. স্টারলিংকের অ্যাকশন ফিগার
স্পেসএক্স একসময় বাজারে এনেছিল একটি স্টারলিংকের অ্যাকশন ফিগার সেট। এই ক্ষুদ্র রেপ্লিকাটিতে একটি জেন টু ডিশ, রাউটার আর দুটি মাউন্ট ছিল, যার দাম ছিল ৪০ ডলার।এটি একদিকে যেমন চমৎকার মার্কেটিং কৌশল, অন্যদিকে প্রযুক্তি-ভক্তদের জন্য ছিল একটি কালেকটরস আইটেম। যদিও এটি এখন আর বিক্রি হচ্ছে না, কিন্তু আজও স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ইতিহাসে এই অ্যাকশন ফিগার এক মাইলস্টোন।
৪. ডাইনোসর-প্রুফ ওয়ারেন্টি
স্টারলিংকের ওয়ারেন্টি বুকলেটে একটি মজার শর্ত রয়েছে: 'ডাইনোসরের কারণে হওয়া ক্ষতির জন্য কোনও ওয়ারেন্টি প্রযোজ্য নয়'। এই রসবোধপূর্ণ শর্তটি ব্যবহারকারীদের ওয়ারেন্টি পড়তে উৎসাহ দেয়। কারণ আমরা তো বেশিভাগ ক্ষেত্রে ওয়ারেন্টি পড়িই না। মজার এই ক্লজটি স্পেসএক্সের সৃজনশীলতার পরিচায়ক। এছাড়া এটি ভবিষ্যত সম্পর্কে স্পেসএক্সের চিন্তাধারাও প্রকাশ পেয়েছে এতে। কারণ বিজ্ঞান নিয়ে একটু কল্পনাপ্রবণ গবেষকরা অনেকেই বলছেন,ডাইনোসরের ফসিল থেকে আবার জীবন ফিরে পেতে পারে এই অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী।
৫. কাস্টম ডিএনএস ও কনটেন্ট ফিল্টারিং
স্টারলিংক ব্যবহারকারীদের জন্য কাস্টম ডিএনএস আর কনটেন্ট ফিল্টারিং করার সুবিধা দেয়। কাস্টম ডিএনএস ব্যবহার করে ব্রাউজিং স্পিড বাড়ানো, গোপনীয়তা নিশ্চিত করা বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের কনটেন্টে প্রবেশ সম্ভব।এছাড়াও স্টারলিঙ্কে বিল্ট-ইন ফিল্টারিং আছে, যা ম্যালওয়্যার ও উলটোপাল্টা ওয়েবসাইট ব্লক করতে পারে। এসব ফিল্টারিং পুরো নেটওয়ার্কের জন্যই প্রযোজ্য। ফলে সব ডিভাইসেই এগুলো কাজ করে।
৬. অ্যাডভান্সড নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য বাইপাস মোড
উন্নত নেটওয়ার্কিং প্রয়োজন হলে স্টারলিংকের বাইপাস মোড ব্যবহার করা যায়। এটি ব্যবহারকারীদেরকে ডিফল্ট রাউটারের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে নিজের ইচ্ছামতো হার্ডওয়্যার ব্যবহার করতে দেয়। এই ফিচার উন্নত হোম নেটওয়ার্ক, পারফরম্যান্স অপ্টিমাইজেশন বা সিকিউরিটি কনফিগারেশনের জন্য উপযোগী, তবে সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য দরকার হয় না।
৭. ডিশের আছে আলাদা নিকনেম
মূল গোল স্টারলিংক ডিশটির অফিসিয়াল নিকনেম বা ডাকনাম ছিল ডিশি ম্যাকফ্ল্যাটফেস। এটি প্রথম দেখা যায় প্রথম দিকের গ্রাহকদের পাঠানো ইনস্টলেশন নির্দেশিকায়।
৮. পরিষেবা শর্তাবলীতে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে ক্লজ
স্টারলিংকের পরিষেবা শর্তাবলীতে লুকানো রয়েছে একটি চমকপ্রদ মার্স বা মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কিত ক্লজ। এখানে বলা হয়েছে, 'মঙ্গল গ্রহে প্রদত্ত পরিষেবা অথবা স্টারশিপ বা অন্যান্য যানবাহনের মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহে যাত্রাকালে প্রদত্ত পরিষেবার ক্ষেত্রে জানানো যাচ্ছে যে, মঙ্গল গ্রহকে একটি মুক্ত গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে এবং পৃথিবীভিত্তিক কোনও সরকার মঙ্গল গ্রহের কর্মকাণ্ডের উপর কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব রাখে না। সুতরাং, যে কোনও বিরোধ মঙ্গল গ্রহে উপনিবেশ স্থাপনের সময় স্বশাসিত নীতিমালার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে'।কাল্পনিক মনে হলেও এরকমই ভবিষ্যত দেখতে পান ইলন মাস্ক মঙ্গল গ্রহকে নিয়ে। এই ক্লজ স্পেসএক্সের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, আইনি দূরদর্শিতা এবং মঙ্গল গ্রহে উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিশ্রুতির প্রকাশ। যদিও এর তাৎক্ষণিক কোনও বাস্তব প্রয়োগ নেই, তবে এটি ভবিষ্যতের মহাকাশ আইন ও বহির্বিশ্বে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।
৯. অ্যাপে মঙ্গল গ্রহে টেলিপোর্ট করার ফিচার
স্টারলিংক অ্যাপে একটি লুকানো ফিচার রয়েছে, যা ব্যবহারকারীদের ভার্চুয়ালি তাদের স্টারলিংক ডিশকে মঙ্গল গ্রহে টেলিপোর্ট করে দেবে। এই ফিচারটি প্রথম চালু হয় ২০২৪ সালের এপ্রিল ফুল দিবসে একটি মজার ফিচার হিসেবে. তবে ব্যবহারকারীদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় এটি স্থায়ী করে দেওয়া হয়।
১০. মহাকাশের আবর্জনা হ্রাসের উদ্যোগ
স্টারলিংক টেকসই উন্নয়নে বিশ্বাসী। এই ইন্টারনেট স্যাটেলাইট প্রতিষ্ঠান মহাকাশে আবর্জনার পরিমাণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
স্বয়ংক্রিয় সংঘর্ষ এড়ানোর ব্যবস্থা
প্রাকৃতিকভাবে পতনের জন্য নিম্ন কক্ষপথে পরিচালনা
ডি-অরবিট প্রোটোকল
উপগ্রহের প্রতিফলন ক্ষমতা হ্রাস
উৎক্ষেপণ ও ফিরে আসার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা
স্টারলিংকের এই দশটি বৈশিষ্ট্য থেকে দেখা যায়, এটি শুধু একটি সাধারণ স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা নয়। সার্কিট বোর্ডে লুকানো বার্তা থেকে শুরু করে মহাকাশের আবর্জনা নিয়ন্ত্রণে দূরদর্শী পরিকল্পনা পর্যন্ত স্পেসএক্সের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, রসবোধ আর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে প্রতিফলিত করে এই ফিচারগুলো। স্টারলিংক যেভাবে ক্রমাগত উন্নতি করছে, ভবিষ্যতে আরও কী কী নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হবে তা দেখার অপেক্ষা করছে সবাই। আর এখন আমাদের দেশের ব্যবহারকারীরাও এই ফিচারগুলো নিজেরাই পরখ করে দেখতে পারবেন।
সূত্র: কিপট্র্যাক
ছবি: ইন্সটাগ্রাম