মাকে ছাড়া মা দিবস কেমন হয়?
শেয়ার করুন
ফলো করুন

সেবার খুব শীত পড়েছিল। আম্মা নিজে আসতে পারেননি; কিন্তু মসলা ভাঙানোর দোকান থেকে চালের গুঁড়ি করিয়ে কেয়ারটেকারকে দিয়ে আমার বেইলি রোডের বাসায় পাঠিয়েছিলেন।  ল্যান্ডফোন থেকে কল করে বলেছিলেন, 'পিঠা বানিয়ে খাবে, আমার নাতিদের শীতের পিঠা খাওয়াবে'। যতই চেষ্টা করি আম্মার মতো এত সুন্দর খোলা-জালি পিঠা বানাতে পারি না। শেষমেশ মাটির খোলা, সরু দস্তার খুন্তি—সবকিছু নিয়ে এক ছুটির সকালে ইন্দিরা রোডে মায়ের বাড়িতে গেলাম। খোলা-জালি পিঠার গোলা করে দেওয়া, পানির উষ্ণতা কতটুকু হলে পিঠায় জালি হবে, সেসব দেখিয়ে দেওয়া চলল। সঙ্গে এক অব্যর্থ কায়দা বাতলালেন আম্মা। 'পিঠাটা তুলে আলোর কাছে ধরলে যদি অনেক বেশি আলো পিঠা ভেদ করে তোমার চোখে পড়ে, বুঝবে পিঠা হয়ে গেছে। আর যদি পিঠাটা রুটির মতো ছিদ্রহীন থাকে, তাহলে পিঠা হয়নি'। কয়েকটা পিঠা সাহস করে বানালাম। কেমন হয়েছিল জানি না। নারকেল–গুড় দিয়ে খুব তৃপ্তি নিয়ে আম্মা খেয়েছিলেন। হয়তো আমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই।

আম্মার জানালা
আম্মার জানালা
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আম্মার স্মৃতি
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আম্মার স্মৃতি

কতকিছুই তো মনে পড়ে মেমোরি লেন ধরে হাঁটলে। কোনো এক প্রবাসী আত্মীয় খুব নরম, একদম হাতের মুঠোয় পুরে নেওয়া যায়, এমন এক শীতের চাদর আম্মাকে উপহার দিয়েছিলেন। মেড ইন প্যারিস। শীতকালে আম্মার বাসায় গেলেই সেই চাদরটা খুঁজতাম। বয়স হয়ে যাওয়ায় আম্মা অনেক কিছুই মনে রাখতে পারতেন না। আমাকে বলতেন, কোথায় যে রেখেছি, দেখ তো খুঁজে কাঠের আলমারিতে। আমার আর খোঁজা হতো না। খুব শ্বাসকষ্ট যেদিন আরম্ভ হলো, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা ছোট ক্যারিঅন লাগেজে কয়টা কাপড় আর নিত্যদিনের ওষুধ-ইনসুলিন যখন গুছিয়ে নিচ্ছি, তখন সেই চাদরটা খুঁজে পেলাম। আম্মার গায়ে জড়িয়ে দিলাম। তিনি বললেন, এটা তুমি রাখো। আমার আর চাদরের দরকার হবে না। আমার হৃদয়টা তখনই মুচড়ে উঠেছিল।

বিজ্ঞাপন


হাসপাতালের প্রবহমান ঘটনাগুলো হয়তো অনেকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যাবে। কেবিন থেকে এইচ-ডি-ইউ। সেখানেও যখন সাপোর্ট সিস্টেম কাজ করছিল না, তারপর আইসিইউ। আই সি ইউ মানে কি আমি তোমাকে দেখি? না তো! আইসিইউ এমন এক স্থান, যেখানে একটিও জানালা নেই। একটিও ঘড়ি নেই পেশেন্টের জন্য। দিন না রাত, সকাল না বিকাল, কিচ্ছু বোঝার কোনো উপায় নেই। আপনজন কেউ পাশে নেই। সারা দিন টিউবলাইটের আলোয় আলোকিত ছোটখাটো এক মৃত্যুপুরী। ভিজিটিং আওয়ারের সময় আম্মা  শ্বাসকষ্টের মাঝেও নিশ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করতেন, আজ কি রোদ উঠেছে? বাইরে কি এখন সকাল না বিকেল? কার্বন ডাই–অক্সাইডের লেভেল কিছুটা স্ট্যাবল হলে, শরীরে একটু শান্তি এলে বলতেন, আমার শীতের রোদে বসে এক কাপ চা খেতে খুব ইচ্ছা করে।

আম্মার পছন্দের শাড়ি
আম্মার পছন্দের শাড়ি
আম্মার কাছ থেকে শেখা আচার
আম্মার কাছ থেকে শেখা আচার


রোদ যদি পার্সে করে নিয়ে যাওয়া যেত, তবে আমি ডাবের পানি, চিকেন সুপের সঙ্গে এক বাক্স রোদ্দুর আম্মার জন্য নিয়ে যেতাম। সেই সুযোগ আমাদের না দিয়ে তিনি চলে গেলেন ডিপ কোমায়। শরীরে ওয়াটার রিটেনশন বাড়তে থাকল। কিডনি ফেইল করল,  সব সময় হাতে পরে  থাকা দুই গাছি স্বর্ণের চুড়ি কবজির সঙ্গে এঁটে যেতে থাকল।

বিজ্ঞাপন

রোজ সকাল ১১টায় যমের দুয়ারের মতো দেখতে আইসিইউর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কখন দ্বার খুলবে! কখন আম্মার কাছে যেতে পারব? কিন্তু পড়ে থাকা নিশ্চল দেহ, মনিটর থেকে বিপ-বিপ শব্দ এবং হাজার হাজার নল, পাইপ আর তারের ভিড়ে আম্মার অচেতন শরীরটাকে অচেনা মনে হতো। আমি আম্মার ডান হাতটা ধরে থাকতাম কিছুক্ষণ। তখন হাসপাতালের বাইরে বসন্তের উপস্থিতি। গাঁদা, কসমস আর চন্দ্রমল্লিকার সমারোহ। আম্মার জন্য গাঁদা ফুল নিয়ে যেতাম, যেটা তাঁর হাতে কখনোই দেওয়া হতো না।  আম্মার হাতটা খসখসে। সারা জীবন সংসার, রান্নাবান্না, বাগান করা, সেলাই করা, আমাদের যত্ন নেওয়া সেই হাতে হাজার অযত্নের চিহ্ন। তখন সেই হাত শীতল।

তিনি আমাদের পাশে না থাকলেও কাছেই থাকেন

ফেব্রুয়ারির শেষ শুক্রবার দুপুরে সেই বিপ বিপ শব্দ একেবারেই  থেমে গেল। শীতল হাত আরও শীতল হলো। ডিপ কোমা থেকে তিনি নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করলেন। পড়ে থাকল শীতের পিঠা, ল্যান্ডফোন, প্যারিসের মাখনরঙা শীতের চাদর। পড়ে থাকল বসন্তের রোদ্দুর। পড়ে থাকল আম্মার প্রিয় গান—আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...।  
মা দিবস আজ। এ দিনটি মাকে ছাড়াও মন ভরে উদ্‌যাপন করা যায়। কারণ, তিনি আমাদের পাশে না থাকলেও কাছেই থাকেন। স্মৃতির অলিগলিতে, তাঁর রান্নার প্রণালিতে, তাঁর শেখানো আচারের আয়োজনে, খোলা–জালি পিঠায়, বাগানে ফোটা ফুলের মাঝে আম্মাকে খুঁজে পাই। আম্মার পছন্দের শাড়ি বা শালের আদরে তিনি জড়িয়ে আছেন। আম্মার জানালাটা দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি তাঁকে আজ অসীম অন্তরিক্ষে।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ১৫: ২০
বিজ্ঞাপন