হোম অফিসের টোম–কাহিনি ৩
শেয়ার করুন
ফলো করুন

নিনজা–সন্ধ্যা
‘হাই, তুমি তাফসু মিয়ার মা, সাবরিনা। তাই না?’ সামনে দাঁড়ানো চওড়া কাঁধের লম্বা তরুণের উৎসুক প্রশ্ন।

‘ইয়ে, হ্যাঁ’ বলেই ঢোঁক গিললাম। তাফসু মিয়ার মা হিসেবে এযাবৎকাল স্কুল থেকে অভিযোগ ছাড়া আর কিছু শুনিনি দেখে খটকা লাগছে। হয় অঙ্কে রসগোল্লা, নয়তো জার্মান ব্যাকরণে বুন্দিয়া লাড্ডু। তাই স্কুল-লাগোয়া এই স্পোর্টস হলের দরজায় ‘তাফসু মিয়ার মা’ সম্বোধনটা ঘাবড়ে দিল।

কিন্তু না, শঙ্কা হটিয়ে ছেলেটা একগাল হেসে স্বাগত জানাল, ‘হের্জলিশ ভিলকমেন। শেষ পর্যন্ত ছেলে তোমাকে পটিয়ে-পাটিয়ে পাঠিয়ে দিল। মা-ছেলে একসঙ্গে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং তলোয়ার ঘোরাবে। দারুণ দারুণ। বাই দ্য ওয়ে, বিকেলের ক্লাসে তাফসু মিয়া আজকে জটিল খেলেছে।’

বিজ্ঞাপন

বোকাটে হাসিতে হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বুঝলাম, নাহ্‌, ছেলে এখানে কোনো প্যাঁচ লাগায়নি। বরং এই সোর্ড ফাইট ক্লাবে সামান্য হলেও তার নামডাক আছে দেখছি।
‘আমার নাম সেবাস্তিয়ান। কিন্তু বাস্তি বলে ডাকতে পারো। আর এই নাও, ধরো ক্যাচ’ বলেই প্রকাণ্ড এক কাঠের তরবারি নাক বরাবর ছুড়ে দিল বাস্তি। সেটা মাটিতে পড়ে বিকট ঠকাস হওয়ার আগেই কোনোমতে জাপটে ধরে পতন ঠেকালাম।

সোর্ড ফাইটের ক্লাবটা এখানেই
সোর্ড ফাইটের ক্লাবটা এখানেই

তলোয়ার কাঠের হলে হবে কী, লোহার মতো ভারী। ক্লাস থ্রি–পড়ুয়া সাড়ে চার ফুটের তাফসু মিয়া এই বস্তু আলগায় কী করে, তা–ই ভাবছি। নাকি ছোটদের বিকেলের ক্লাসের তলোয়ারও ছোট আর হালকা।

ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে বাস্তি বলল, ‘তোমাকে তো বিগিনার্স সোর্ড দিয়েছি। তাফসু মিয়া অলরেডি ইয়েলো বেল্ট। তার তলোয়ার আরেকটু বড় আর ভারী। এত ভেবো না তো। ছেলে পারলে মা–ও পারবে। চলো, তোমাকে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।’

বিজ্ঞাপন

বাস্তির পিছু পিছু এগোচ্ছি। ওদিকে মন খচখচ করছে। এই নভেম্বরের জাঁকালো শীতের গা–কাঁপানো সন্ধ্যায় কোথায় ছেলে আর তার বাবার সঙ্গে গরম–গরম দুটো ডাল-ভাত খেয়ে ঝিমোতে থাকব, তা না করে কী এক ছেলেমানুষিতে নেমেছি। কিন্তু এ ছাড়া যে উপায়ও দেখছি না। হোম অফিস নামের আজব এক চক্করে পড়ে নড়নচড়ন বন্ধ হয়ে গেছে আজ মাসখানেক। সারা দিন ওই এক টেবিল-চেয়ার আঁকড়ে পড়ে থাকা। হাতে-পায়ে বটগাছের মতো শিকড় গজিয়ে গেছে। তাই হাড়গোড়ের জং ছোটাতে হাজির হয়েছি ‘রিমারলিঙ্গার স্পোর্টস ক্যাম্পাস’-এ। তা–ও যদি কয়টি বানরলাফ লাফিয়ে সারা দিনের আড়ষ্টতা কাটে আরকি!

যাহোক, অন্যদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। জনাবিশেকের মধ্যে এক-আধজন বাদে সবাই মোটামুটি টিনএজ ছেলেপুলে। এত তেরো-চৌদ্দ-পনেরো-ষোলোর মাঝে নিজেকে রীতিমতো রোয়া–ওঠা বুড়ো ভাম বিড়াল মনে হচ্ছে। ইশ্, কেন যে এলাম!
অস্বস্তিটা বুঝে নিয়ে দলের একমাত্র বয়স্ক ভদ্রলোক গলাখাঁকারি দিয়ে বলে উঠল, ‘আরে, এখানে আমরা সবাই একবয়সী। দরজা ঠেলে হলে ঢোকার আগে আমার পঁচাত্তর বছর বয়সটা জুতা আর পানির বোতলের পাশে রেখে আসি। কেমন বুদ্ধি বলো তো? হা হা হা...।’ কথাটা বেশ মনে ধরল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, আরে ইনি তো অবিকল আমার শ্বশুর মশাইয়ের মতো দেখতে। সেই রকম ছোট করে কাটা একমাথা সাদা চুল আর হালকা চাপদাড়ি। সঙ্গে মিটিমিটি হাসি। হাসতে হাসতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি পিট। চলো, একপাঞ্জা তরবারি লড়ে ফেলি।’

কথা না বাড়িয়ে পিটের সঙ্গে চলতে চলতে ভাবছি, শ্বশুর আব্বা যদি জানতেন যে তাঁর সাদামাটা আটপৌরে ছেলের বউ তাঁরই নাতির মন্ত্রণায় এই মাঝবয়সে সোর্ড ফাইট ক্লাবে নাম লিখিয়েছে, তাহলে চেহারাটা কী দাঁড়াত!

পিট একটা ছোট্ট ভূমিকা ঝেড়ে দিল, ‘বুঝলে, আমাদের টেকনিক কিন্তু সামুরাই-নিনজা-ভাইকিং-মিডিভাল—এই সবকিছুর জগাখিচুড়ি। আবার কারাতে-তায়কোয়ান্দো থেকেও কিছু কায়দাকানুন ধার করা। বহু পুরোনো সব লড়াইয়ের কলাকৌশল মিলিয়ে–ঝিলিয়ে নতুন নাম দিয়েছি ‘মডার্ন সোর্ড আর্ট’। নতুন বোতলে পুরোনো মদ, হা হা হা...।’ পিটের কথা শুনে চারপাশে একবার চোখ বোলাতেই রোমাঞ্চ জাগল। সবার পরনে নিনজাদের মতো কালো ঢোলা পোশাক। কারও কারও মুখে ফেন্সিং মুখোশের মতো নেটের মুখোশ। গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্টের মতো পুরু একধরনের বর্ম। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঘরের মাচা থেকে লাফিয়ে নেমে ধড় থেকে মাথা ফেলে দেবে এক কোপে, বাবা গো!  

হাতের তলোয়ার লগবগ নড়ছে। তাই দেখে পিট শুধরে দিয়ে দেখিয়ে দিল কী করে দুই হাতে ভারটুকু ভাগ করে দিয়ে অনায়াসে পাকা সৈন্যের মতো অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা যায়।
‘এবার তোমার পালা। দাও তো দেখি কাঁধ বরাবর জোরসে একটা মার।’ পিটের দেখানো ভঙ্গিতে সভয়ে দিলাম মোলায়েম এক ঘ্যাচাং। জোরসে ঘ্যাচাং দিলে বুড়োর যদি মাথা ফেটে যায়, সেই ভয়ে! অবাক করে দিয়ে মুহূর্তেই পিট খুব অবলীলায় আক্রমণটা ঠেকিয়ে দিল তরবারি আলতো উঁচিয়ে।

‘ভয় পেয়ো না, এই বুড়োর মাথা ফাটবে না এত সহজে।’ পিট দেখি মাইন্ডরিডার। লজ্জা পেয়ে চোখ পিটপিট করছি দেখে সে দ্বিগুণ উৎসাহে বলল, ‘আবার দেখো। বুক চিতিয়ে এভাবে পা বাড়িয়ে দাঁড়াবে, আর তলোয়ারটা হালকা নুইয়ে বাতাস কেটে আঘাত করবে। নাও দেখি, এক-দুই-তিন, মারো। হাইয়াহ্!’  

পরের ঘণ্টায় পিট আমাকে মোটামুটি তলোয়ার চালানোর অ আ ক খ দেখিয়ে দিল। কী করে এফোঁড়-ওফোঁড় ঘচাৎ মেরে ভুঁড়ি গেলে দেওয়া যায়, কী করে পাল্টা আঘাতে প্রতিপক্ষের ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেওয়া যায় ইত্যাদি জরুরি টেকনিক। সে বিদ্যা কতটুকু পেটে গেল, বলা মুশকিল। তবে নতুন কিছু শেখার মাঝে তিরতিরে আনন্দ আছে। তা ছাড়া একঘেয়ে, ম্যাড়মেড়ে যান্ত্রিক রুটিন জীবন থেকে বেরিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় নিজেকে নব্য নিনজা ভাবতে ভালোই লাগছে। অতি অলস এই বাঙাল তার কাছিম-খোলস ছেড়ে এ শীতের সন্ধ্যায় কতগুলো লড়াকু জার্মানের পাল্লায় পড়ে ভুলভাল ঠুকঠাক তলোয়ার ঠুকছে আর তিড়িং-বিড়িং ব্যাঙ লাফিয়ে ঘাম ঝরাচ্ছে—এ–ও এক আজব ঘটনা বটে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
ছবি: পেজকেলসডটকম

ঘড়ির কাঁটা ঘুরে রাত সাড়ে আটটায় থামল। আজকের মতো তলোয়ার ঘোরানোর এখানেই ইতি। সবাইকে এক সার হয়ে দাঁড়াতে বলছে সেবাস্তিয়ান ওরফে বাস্তি নামের ছেলেটা। লম্বা একটা ‘বাউ’ করে ছুটি মিলল সেদিনের মতো।

হল থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে পিট শুধাল, ‘সামনের সপ্তাহে এসো। তলোয়ারের সঙ্গে ঢাল থাকবে তখন। অফেন্স-ডিফেন্স-কাউন্টার অ্যাটাক, হাইয়াহ্! কী আসবে তো?’ বলেই পিট সহাস্যে বিদায় নিয়ে পানির বোতল হাতে রওনা দিল। যাওয়ার সময় সে তার বয়সটা সঙ্গে নিতে ভুলে গেল মনে হয়। পঁচাত্তরের পিটকে এখনো পঁচিশের ছোকরার মতো দুরন্ত-দুর্বার দেখাচ্ছে।

ঢাল-তলোয়ারে মারমার-কাটকাট আরেকটা সন্ধ্যার হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন। সামনের সপ্তাহে আসতেই হবে। হালকা পায়ে ভারী কুয়াশা ফুঁড়ে ফুটপাত ধরলাম। পাশ কাটিয়ে সাইকেলে চেপে হুস করে উড়ে গেল বাস্তি, ‘হেই সাবরিনা, পরের ক্লাসে তাফসু মিয়াকে নিয়ে এসো। মা-ছেলের ডুয়েল জমবে খুব। ওকে, বাই...।’  

লেখক: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার জার্মানির মিউনিখে একটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সংস্থায় মেডিকেল রাইটার হিসেবে কর্মরত

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬: ০০
বিজ্ঞাপন