আম্মার হাতের মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ স্বর্গীয়: আলপনা হাবিব
শেয়ার করুন
ফলো করুন

প্রফেসর আফজালুননেসা আমার মা। আম্মা ডাকটা যেন সহজাত। একধরনের প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া আরাম। স্বস্তির আশ্রয়। প্রতিটি বিবাহিত মেয়ের জীবনে আম্মার বাসা সত্যিই এক অভয়াশ্রম। এর মধ্যে আছে আহ্লাদ, আবদার এবং বেয়াড়া রকমের অধিকারবোধ। নিজের যত স্বাচ্ছন্দ্য আর বিলাসী জীবন থাকুক না কেন, ওই স্নেহমণ্ডিত আশ্রয়ের উষ্ণতার সঙ্গে কোনো তুলনা হয় না। মাকে আমরা গ্র্যান্টেড হিসেবে নিয়ে নিই। স্বামীর ওপর রাগ মায়ের ওপর ঝাড়ি, সন্তানের ওপর বিরক্তির প্রত্যুত্তরে শুধু অসহায় চিন্তাক্লিষ্ট একটি চেহারা। সেখানে একটাই প্রশ্ন, কী করে মেয়ের কষ্ট লাঘব হবে।

পরিবারের সকলের সঙ্গে আম্মা
পরিবারের সকলের সঙ্গে আম্মা

নিজের দুশ্চিন্তাগুলোকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি। তা–ও মায়ের অনুসন্ধিৎসু চোখ ঠিক ধরে ফেলেছে আমার চেহারার ভাষা। ধরা পড়ে গিয়ে আবার তার ওপর সেই কী মেজাজ—কেন এত চিন্তা করো তুমি আমাদের নিয়ে। এখন আর কেউ ভাবে না সেভাবে। অসুস্থতায় চিন্তাক্লিষ্ট মুখটা নিয়ে মাথায় বোলানো হাতটা আজ আর কেউ বুলিয়ে দেয় না।

বিজ্ঞাপন

আমার মা একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার হিসেবে জীবনের চল্লিশটা বছর কাটিয়েছেন তুমুল ব্যস্ততায়। তার চেয়েও কঠিনতম বাস্তবতা হলো মাত্র ৪৬ বছর বয়সে বিধবা হলেন। ২১, ১৫ আর ১৪—এই কঠিন বয়সের তিন সন্তানকে নিয়ে। আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন জীবনে চলার পথে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ, তা যাচাইয়ে বোধ। তারপর ছেড়ে দিলেন জীবনের পথে। এর ফলে আমরা তিন ভাইবোন আত্মবিশ্বাস নিয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে শিখেছি। চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। পেছন ফিরে তাকাই না। কেন হলো, না হলে কী হতো—এসব ভাবি না। বরং সামনে কীভাবে এগোব, সেই দিকেই মনোনিবেশ করি। মাকে দেখে শিখেছি কেমন করে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। কীভাবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজ ও চরিত্রের সুরক্ষা করতে হয়।

মায়ের কোলে
মায়ের কোলে
সর্বোচ্চ পেশাগত অর্জনের মুহূর্তে আম্মা
সর্বোচ্চ পেশাগত অর্জনের মুহূর্তে আম্মা


অন্যদিকে আম্মা ঝাঁপ দিলেন জীবিকার কাজে। উদয়াস্ত মাথা ঠান্ডা রেখে মাতৃসুলভ ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাসপাতালের বিভাগ সামলানো থেকে বিভিন্ন ক্লিনিকে অ্যানেসথেসিয়া দিতে ছুটে বেড়িয়েছেন। আজ অবধি তার ব্যবহার ও স্নেহ কেউ ভুলতে পারেনি। কর্মের প্রতি তার এই নিষ্ঠা ও আত্মনিয়োগ নিজের অজান্তেই তার জন্য কর্মক্ষেত্রে এনে দিয়েছে বিরল সম্মান। মায়ের এই অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা অন্তত এই প্রতীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছি যে মা–বাবার অসম্মান হয়, এমন কোনো কাজ করব না। আমার সৌভাগ্য, শেষ ১৪ বছর আমার মা আমার বাসার নিচের তলায় থাকতেন। প্রচণ্ড স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভরশীল ছিলেন। তাঁর জন্য আমি কী করব, তিনিই সারাক্ষণ আমার খেয়াল রাখতেন। কিচ্ছু চাইতেন না। চাওয়ার মধ্যে কেবল ছিল একটু সময়। সেটাও হেলা করে ঠিকমতো দিতাম না। এখন নেই। এখন তাই আফসোস করি কেন আরেকটু সময় দিলাম না। তাই বলি, যাঁদের মা বেঁচে আছেন, তাঁরা প্রতিমুহূর্ত উপভোগ করুন। চলে গেলে আর পাবেন না। যাঁদের বাবা নেই, তাঁদের জীবন কোনো না কোনোভাবে কেটে যায়। কিন্তু যাঁর মা নেই, তাঁর যেন কেউ নেই।

বিজ্ঞাপন

যখন তাঁর উদয়াস্ত কাজের ব্যস্ততা, তখন তাঁর রান্নাবান্নার দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসতটুকুও ছিল না। আম্মার সারা জীবন রান্নার নামে জ্বর আসত। কিন্তু শেষ বয়সে অবসরজীবনে নাতি-নাতনি এবং মেয়ে-জামাইদের নিয়ে খাওয়ার জন্য এই হালকা স্বাদের অসাধারণ মোরগ পোলাও রান্না করতেন। আমার সৌভাগ্য যে আমি সেই রান্নাটি রপ্ত করে রেখেছি। মাদার্স ডেতে সেই রান্নাটি আজ করতে গিয়ে এর স্বাদ এবং গন্ধ আমাকে নিয়ে গেল আম্মার বাসায়।

মহাসমারোহে আম্মা আমাদের জন্য এই মোরগ পোলাও রাঁধতেন। কী তার আয়োজন। এক বুয়া লুছনি হাতে, আর এক বুয়া খুন্তি ধরে থাকত। আম্মার ইঞ্জিন গরম। যেন এর চেয়ে দশটা রোগীর অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া অনেক সহজ। যুদ্ধ শেষে এই সুকর্মটি টেবিলে যখন পরিবেশিত হতো, তখন আমাদের কারও মুখে কোনো কথা থাকত না। সবাই এর স্বর্গীয় আস্বাদ গ্রহণে মহাব্যস্ত হয়ে পড়তাম।

আজ আম্মা নেই, আছে শুধু স্মৃতি
আজ আম্মা নেই, আছে শুধু স্মৃতি

আজ আম্মা নেই। নেই আম্মার বাসা। নেই আম্মার বুয়ারা; যারা গেলেই কী খাব বা কী প্রয়োজন, তাই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত। নেই আম্মার গাড়ি, ড্রাইভার; যাতে যখন-তখন চড়ে বসে বলতাম আমাকে অমুক জায়গায় নিয়ে চলেন। নেই রান্না-খাওয়া, খালাদের আড্ডা। একটা রান্না যে এভাবে একসময়ের স্বাদকে ফিরিয়ে আনতে পারে 'আম্মার মোরগ পোলাও'একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এর স্বাদের মূল্য আমার কাছে অপরিসীম। আপনাদেরও মন্দ লাগবে না। আপনারা আমার বিদেহী মায়ের আত্মার জন্য দোয়া করবেন। আমার কাছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তই মাদার্স ডে। পৃথিবীর সব মাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা। রেসিপি লিংকটাও দিয়ে দিলাম। বানিয়ে খেয়ে দেখবেন অবশ্যই।

ছবি: লেখকের পারিবারিক অ্যালবাম

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৪, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন