নারীর স্বাধীনতার সঙ্গে চিরকালই একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের সহাবস্থান। আচার-আচরণকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে নিয়মের ছকে। কারণ হিসেবে দর্শানো হয়েছে নিরাপত্তার অভাব আর জীবনের সুখশান্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে নারীর স্বাধীনতা ও নিজস্বতাকে এগুলোর বিরুদ্ধশক্তি না ভেবে তাঁকে সহযোগিতা করলেই কেবল সম্পর্কে সুখের অস্তিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব। যেকোনো সম্পর্কই টিকে থাকে সহযোগিতা , সম্মানবোধ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মিথস্ক্রিয়ায়। নারীর সবচাইতে বড় সহযোগী হতে পারেন তাঁর প্রেমিক, তাঁর স্বামী। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই স্বামীরা এর উলটোপথে হাঁটেন। আর অনেক ক্ষেত্রে হারিয়ে ফেলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে। এমনই হয়েছে এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত সিনেমা উৎসবে।
এই সিনেমার 'ডানা থাকলেই উড়তে হয় না, জেসমিন' এখন এক ভাইরাল সংলাপ আর সামাজিক মাধ্যমে ট্রেন্ডিং মিম ম্যাটেরিয়াল৷ আচ্ছা, ভাবুন তো কী কী করলে আমাদের আশেপাশের জাহাঙ্গীররা আর জেসমিনদেরকে হারিয়ে ফেলবে না? নারীর ডানা কেটে দিয়ে নয়, বরং নিজেই তাঁর ডানা হয়ে উঠে পাশে থাকলে জীবনের মানে হয় যাবে অন্যরকম সুন্দর। আর এই কথাটাই জাহাঙ্গীররা বুঝতে পারে না। হারিয়ে ফেলে জেসমিনদের।
'ডানা থাকলেই উড়তে হয় না, জেসমিন' ডায়লগের মিমগুলোতে হাস্যরসের প্রাধান্য বেশি থাকলেও সংলাপটি কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ভালোবেসে ডানা কাটতে না চেয়ে বরং জেসমিনদের ডানাকে মজবুত করে জিতে যেতে পারেন জাহাঙ্গীরেরা। কারণ সহযোগিতা আর পাশে থাকার প্রত্যয়ই হয়ে উঠতে পারে ভালোবাসার শক্তি।
একটু স্পয়লার হয়ে যাক। মেধাবী নির্মাতা তানিম নূর পরিচালিত 'উৎসব' সিনেমার শীর্ষদৃশ্যে দেখা যায় তরুণ নায়ক জাহাঙ্গীর, স্ত্রী জেসমিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র লুকিয়ে ফেলছেন। কারণ তিনি চান না তাঁর স্ত্রী ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করুক। তাঁর মনে ভয়ের সঞ্চার হয়, যদি জেসমিন তাঁকে ভুলে যায়? এই দৃশ্যে জাহাঙ্গীরের ভয়ের কারণ বুঝতে পারেন অনেকেই। হন সমব্যথীও। তবে অধিকাংশ মানুষই তাঁকে দোষ দেন ,দাঁড়া করান আসামীর কাঠগড়ায়। কারণ বিয়ের আগে হবু স্ত্রীর কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভুলে যাচ্ছেন তিনি। বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। দর্শকের মনে যখন এই দৃশ্য নিয়ে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া,তখনই জেসমিন মাস খানেক পরে নিজের প্রবেশপত্র খুঁজে পেয়ে জাহাঙ্গীরের কাছে উত্তর চেয়ে বসে। দর্শক ভাবেন,'কী হবে এবার?'' জাহাঙ্গীর চোখ ভর্তি পানি নিয়ে জানায়, সে জেসমিনকে অনেক ভালোবাসে; জেসমিনের ভবিষ্যৎ তার সঙ্গে, এখানেই! এরপরই আসে সেই বিখ্যাত সংলাপ। 'ডানা থাকলেই উড়তে হয় না জেসমিন। কিছু সম্পর্ক বাঁচায় রাখার জন্য নিজের স্বপ্নরে মাইরা ফেলতে হয়।' আমাদের সমাজে কতশত নারীকে যে এই হুবহু একই দৃশ্যের সত্যিকারের রূপটির কুশীলব হতে হয় তা গুণে শেষ করা যাবে না৷ তাই তো এই দৃশ্যের মাঝে নিজেকে খুঁজে পাই আমরা অনেকেই।
জাহাঙ্গীর ঠিক বলেছেন নাকি একেবারেই ভুল এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলছে থাকে তর্ক-বিতর্ক। অনেকের অভিমত, জাহাঙ্গীরের আশঙ্কা ভুল নয়। বাস্তবজীবনে এরকম অনেক উদাহরণ আমরা প্রায়ই দেখি। আসলে একটি সম্পর্কে নারী ও পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বী নন। আর সবসময় নারীকেই তাঁর সবকিছু বিসর্জন দিতে বাধ্য করা বা তাঁর ডানা থাকলেও তা কেটে ফেলার মতো কাজগুলো করতে থাকলে একসময় জাহাঙ্গীররা জেসমিনদেরকে হারিয়ে ফেলবেন। এই হারিয়ে ফেলা উৎসব সিনেমার মতো ট্রেনে করে চলে যাওয়া যেমন হতে পারে, তেমনি একই ছাদের নিচে বসবাস করেও মানুষ হারিয়ে ফেলতে পারে একে অপরকে। আমরা বরং ইতিবাচক কিছু ভাবি। ভেবে দেখি আসলে কী কী করলে আমাদের সমাজের খুব চেনা এই জাহাঙ্গীররা ডানা মেলে উড়তে চাওয়া জেসমিনদেরকে হারিয়ে ফেলবে না। বরং একে অপরের ডানা হয়ে উঠবে৷
সঙ্গীর 'পার্সোনাল স্পেস' কে সম্মান করা
এই স্পেস হতে পারে অ্যাবস্ট্রাক্ট একটি ধারণা৷ যেখানে সঙ্গী একটি সীমা মেনে চলেন। আপনাকে স্পেস দেন। আবার আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব একটি পরিমণ্ডল বা জগতের প্রয়োজন হয়। হতে পারে সেটি শুধু একটি ঘর, একটি বারান্দা, তাঁর বন্ধুদের আড্ডা বা শখের কোনো কাজের কর্নার। ব্যক্তিগত জায়গা বা 'পার্সোনাল স্পেস' এ মানুষ নিজের মতো করে থাকতে চায়। নারীদের ক্ষেত্রে এই জায়গাটুকু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। একটি সম্পর্কে আছেন কিংবা বিবাহিত বলে কারো একান্ত ব্যক্তিগত সময় কাটানোর প্রয়োজন হতে পারে না,এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। প্রতিটি মানুষেরই একটি নিজস্ব স্বত্ত্বা আছে। আপনার সঙ্গীর 'ব্যক্তিগত জায়গা' ও 'নিজস্ব স্বত্বা'কে সম্মান করুন। তবেই সম্পর্ক সুন্দর হবে।
সঙ্গীর স্বপ্নকে নিজের করে নেওয়া
স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রতিদিনের হাজারো সমস্যার সমাধান করে মানুষ এগিয়ে যায়। প্রেরণা জোগায় স্বপ্ন। যেমন জেসমিনের স্বপ্ন ছিল ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করা। জাহাঙ্গীর বলেছিল সেই স্বপ্নে সে তার সঙ্গী হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার কথা রাখেনি। আপনার সঙ্গীরও যদি এমন কোনও স্বপ্ন থেকে থাকে, সেটিকে নিজের স্বপ্নের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভাবুন এবং পূরণে সাহায্য করুন। নারী বলে তাঁর স্বপ্ন থাকতে পারবে না, এই ধারণা থেকে বের হতে হবে৷আপনার সঙ্গী আপনার প্রতিযোগী নন :জীবন প্রতিযোগিতায় ভরা। এক মুহূর্ত কেউ এই ম্যারাথনে পিছিয়ে পড়তে চায় না। তবে আপনার সম্পর্ক যেন হয় আপনার শান্তির জায়গা।
সম্পর্ককে যুদ্ধক্ষেত্রের অংশ করে তুলবেন না। আপনার সঙ্গীকে বন্ধু ভাবুন। জাগতিক সমস্যা সমাধানে তাঁকে নিজের অংশ মনে করুন। হতেই পারে আপনার চেয়ে আপনার সেই সঙ্গী বেশি সৃজনশীল কিংবা বেশি সফল। কোনো মানুষই নিখুঁত নয়। কাজেই আপনার সেই সঙ্গীর সৃজনশীলতা ও সফলতায় পিঠ চাপড়ে, হাতে বা কাঁধে হাত রেখে তাঁর পাশে থেকে তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহস দিন। মনোবল যোগান।
নারী সঙ্গীর উপার্জন ও পেশাগত জীবনকে সম্মান করা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে 'নারীর উপার্জিত অর্থে সংসার চালানোর ধারণাটিকে রীতিমতো ব্রাত্য ভাবা হয়। এদিকে লাখ লাখ পেশাজীবী নারী সংসারের খরচে অবদান রেখেই যাচ্ছেন সম্মান বা স্বীকৃতি ছাড়া। দুইজন মানুষের সহাবস্থানেই একটি সম্পর্ক সুন্দর হয়। আবার আপনার সঙ্গীর উপার্জন ও সফলতা আপনার চেয়ে বেশি হতেই পারে। এতে নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন না করে বরং তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করুন। তাঁর পেশাকে সম্মান করুন। উপার্জনের স্বীকৃতি দিন।
সঙ্গীকে সময় দেওয়া, তাঁকে দেওয়া কথা রাখা
জাহাঙ্গীর জেসমিনকে ভালোবেসেছিল। তবে তার গল্পে বাধা হয়েছিল সময়। বিয়ের পর জেসমিন ও তার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সে প্রচুর অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জেসমিনের ছোট ছোট ইচ্ছা আর স্বপ্নপূরণে সময় দিতে ভুলে যায় জাহাঙ্গীর। হারিয়ে ফেলার আগেই আপনার সঙ্গীকে সময় দিন। তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তাঁকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তা অবশ্যই পালনের চেষ্টা করুন। কথা দিয়ে রাখতে না পারলে বিশ্বাস ভেঙে যায়। এটি যেকোনো সম্পর্কের জন্য খুবই ক্ষতিকর হতে পারে।
'উৎসব' সিনেমার শেষ দৃশ্যে নায়ক জাহাঙ্গীর ভাবে ,কী কী না হলে তাঁর জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। হয়তো 'ডানা থাকলেই উড়তে হয় না জেসমিন' এই কথাটি না বিশ্বাস করলে আর না বললেই তাদের জীবনটা অন্যরকম হতো। উৎসব সিনেমার এই গল্প আমাদের অনেকেরই যাপিত জীবনের সত্যিকারের দৃশ্য। জাহাঙ্গীররা যেন আর জেসমিনদেরকে হারিয়ে না ফেলে, তাদেরকে উড়তে দেয়, নিজেই তাদের ডানা হয়ে ওঠে।
ছবি: চরকির স্ক্রিনশট, ফেসবুক মিম, সাদিয়া আয়মানের ইন্সটাগ্রাম