পুরুষের পাশে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমরা অনেকেই আসলে জানি না আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের কথা। অথচ আজ সেই দিন। পুরুষের আবেগ, দুর্বলতা, ভালোবাসা বা কষ্টের কথাও তেমন অজানা থেকে যায়। ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’,  ‘পুরুষ হয়ে এত আহ্লাদ কিসের’—এমন সব সামাজিক ভ্রুকুটির আড়ালে থেকে যায় তাঁদের অনুভূতিগুলো। আজ পুরুষ দিবস, তা জানেন কি না—এ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেন নিহান। লোরা, মাসুদা আর আফরিন অকপটে জানালেন, এই প্রথম এভাবে জানা হলো দিবসের বিষয়টি।

প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে থাকেন এক নারী, এ কথা হরহামেশা বলা হয়। আজকাল সফল পুরুষের পাশে থাকেন নারী, পেছনে নয়—এটি এখন এক স্বীকৃত সত্য। কিন্তু এই তিন সফল নারীর জন্য পুরুষ কীভাবে ইন্সপিরেশন হয়েছেন, সে কথা দিয়ে মূল আলোচনা শুরু হলো। এ প্রশ্নের জবাবে লোরা খুব সন্তুষ্টি নিয়ে হাসিমুখে বললেন তাঁর স্বামীর কথা, ‘আমার স্বামী সব সময় আমার পাশে আছেন।’ মাসুদার জীবনে পারিবারিকভাবে তাঁর মামারা উৎসাহ জুগিয়েছেন, জানালেন তিনি। আর আর্টের শিক্ষকদের ভূমিকার কথাও বিশেষভাবে বললেন তিনি। তবে আফরিন সুলতানার বয়ানে আবার উঠে এল ভিন্ন চিত্র। তিনি বললেন, কাজের ক্ষেত্রে পারিবারিক সাপোর্ট সব সময় ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও সমাজের চারপাশের নেতিবাচকতা তাঁকে বেশি উদ্দীপনা জুগিয়েছে সাফল্যের পথে। আর এই সামাজিক বাধার এক বড় অংশ যে পুরুষের অবদান, তা–ও মনে করিয়ে দিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

নিহানের এবারের প্রশ্ন ছিল, পুরুষের কাছ থেকে কী আশা করেন এই তিন তরুণী। প্রথমে আফরিন বললেন, ‘একে অপরকে সম্মান করা খুব জরুরি। অনেক সময় দেখি, বিষয়টি থাকে না।’ অন্যরাও বেশ জোরালোভাবে সমর্থন দিলেন এ কথায়। আসলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে ভালোবাসার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়।

ডা. আফরিন সুলতানা
ডা. আফরিন সুলতানা

এবারে এল বহুল আলোচিত অথচ অমীমাংসিত প্রসঙ্গ। ছেলেদের ছোটবেলা থেকে বলা হয়, কাঁদা যাবে না, কষ্ট পাওয়া যাবে না, ইমোশন দেখানো ছেলেদের কাজ নয়, এ বিষয়গুলো কীভাবে দেখেন এই তিন নারী—প্রশ্ন ছিল নিহানের।

প্রথমে আফরিন বলেন, ‘আবেগ বা ইমোশন তো ন্যাচারাল ব্যাপার। ইমোশন দেখানোর ক্ষেত্রে ছেলে–মেয়ের ভেদাভেদ থাকার কিছু নেই। বরং দেখানো উচিত, আর সেটা স্বাস্থ্যসম্মত।’ সমর্থন মিলল আবারও বাকি দুই নারীর।

বিজ্ঞাপন

নাহিন এরপর করলেন আরেক মজার প্রশ্ন। এ নিয়ে যুগে যুগে হয়ে আসছে বিস্তর আলোচনা। প্রশ্নটি হচ্ছে, ছেলে আর মেয়ে কি শুধুই বন্ধু হতে পারে? এবারও প্রথমে শুরু করলেন আফরিন। বললেন, ছেলে–মেয়ের বন্ধুত্বে শুদ্ধতা থাকে না, এটা ভুল ধারণা। মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব হতেই পারে। বাকি দুজন হাসিমুখে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রকাশ করলেন। কী যে ভাবছেন, খুব বেশি বোঝা গেল না।

নিহানও ছাড়ার পাত্র নন। আরও একটু বিশদে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একজন মেয়েবন্ধুর সঙ্গে যেভাবে মেশেন, ছেলেবন্ধুর সঙ্গে কি একইভাবে মেশেন?’ এবার মাসুদার উত্তর দেওয়ার পালা। বললেন, ‘আমার অনেক ছেলে ও মেয়েবন্ধু আছে। তবে আবেগময় বিষয়গুলো ভাগ করে নেওয়া বা মেলামেশায় ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে মেয়েবন্ধুদের কিছুটা ভিন্নতা থাকে। কারণ, আমাদের সমাজে বিষয়গুলো এভাবেই তৈরি হয়েছে।’ লোরার হাসি ছাড়া এ বিষয়ে আর কোনো মতামত স্পষ্ট করে জানা গেল না এত চেষ্টার পরও। তবে পরের প্রসঙ্গে প্রশ্নটি অনেকটা লুফে নিয়েই উত্তর দিলেন তিনি।

প্রশ্ন ছিল, ‘স্বামী খুব চুপচাপ ও ঠান্ডা স্বভাবের আর স্ত্রী খুব চঞ্চল হলে অনেকে অনেক রকম কথা বলেন। আপনাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন?’ প্রেক্ষাপট একেবারে মিলে যাওয়ায় সহাস্যে লোরা বললেন, ‘আমার স্বামী একেবারেই আমার উল্টো। সে খুবই চুপচাপ ও কথা কম বলে। আমি অনেক চঞ্চল আর অনেক কথা বলা মানুষ। এমন হলে অনেকে মনে করে, স্বামী আমার ভয়ে কথা বলে না। বউ অনেক দজ্জাল হবে। কিন্তু একজন মানুষ কম কথা বলে মানে সে ভয়ে কথা বলছে না, এমন নয়। এটা একেকজনের ব্যক্তিত্ব ও স্বভাবের ওপর নির্ভর করে।’ মাসুদা বললেন, তাঁর মনে হয় সমাজে বিষয়টি নিয়ে অনেক গতানুগতিক চিন্তাধারা প্রচলিত রয়েছে। আফরিন বললেন, বিষয়টি খুব কমন মনে হয় তাঁর কাছে।

লোরা খান
লোরা খান

নিহানের ঝুলি থেকে এবার বের হয় আরেক মজার প্রশ্ন, ‘এই যে নারী দিবস এত বিশাল আয়োজনে পালিত হয়, পুরুষ দিবস নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয় না কেন?’
লোরা শুরু করেন প্রথমে। তিনি বলেন, ‘পুরুষদের জন্য বছরের ৩৬৫ দিন একই রকম।’ হাসতে হাসতে বললেন, তাঁর মনে হয় সমাজ অনেকটা হিংসুটে মনোভাব পোষণ করে এ ব্যাপারে। আফরিন অবশ্য আরেকটু সিরিয়াস হয়ে বললেন, ‘আসলে নারীদের ওপর এত চাপ থাকে যে তাঁদের জন্য বিশেষ একটা দিন বের করা হয় আয়োজন করে আর ছেলেরা তো সমাজে অনেক সুবিধা পায় হরহামেশা। তাঁদের জন্য প্রতিদিনই বিশেষ হয়ে ওঠে মেয়েদের তুলনায়।’ মাসুদাও ভেবেচিন্তে বললেন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, ‘আমরা এক পুঁজিবাদী সমাজে বাস করি। এখানে নারী দিবস নিছক এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্‌যাপন করা হয়। পুরুষ দিবস নিয়ে সমাজে আসলে তেমন কোনো প্রচার নেই।’

এবার বেশ মজার এক ঘটনার অবতারণা হয়। নিহানের পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, ‘স্বামীকে কি কখনো তাঁর কাজের জন্য প্রশংসা করেছেন?’

লোরা খানকে এ পর্যায়ে একটি মজার টাস্ক দেওয়া হলো। লাইভে স্বামীকে কল করে বলতে বলা হলো, তিনি তাঁর সব ভালো কিছুর জন্য তাঁকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন দেখার জন্য যে কী হয়। লোরা প্রথমে উত্তরে বলেন, আমি আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করি। আমি তাঁকে অ্যাপ্রিশিয়েট করি সব সময়। এটা সে ভালোমতো জানে। মজা করে বললেন, ‘আপনাদের এখানে নেটওয়ার্ক ভালো নেই। ফোনে তো পাওয়া যাবে না।’

সবার সম্মিলিত হাসির মধ্যে জানতে চাওয়া হলো, লোরা লজ্জা পাচ্ছেন কি না। লোরা হাসতে হাসতে বললেন, ‘না না, আমি লজ্জা পাচ্ছি না। চাইলেই কল দিতে পারি।’
এভাবে জমে ওঠে আড্ডা। এর মধ্যে মাসুদা বললেন তিনি কয়েক বছর ধরে সচেতনভাবে কাছের মানুষদের অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। আফরিন বলেন, ব্যাপারটি তাঁরও মাথায় থাকে সব সময়। লোরা অবশ্য এ প্রসঙ্গে যোগ করেন, ‘আমার স্বামী আমাকে খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করে। আমার ভালো কোনো ডিজাইন দেখলে বলে, কাজটা ভালো হয়েছে। তখন নিজের কাজের আগ্রহ বেড়ে যায়।’ আসলে পাওয়ার কাপল বোধ হয় এমনই হয়। ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্কে জড়ানো।

আরেকটি বহুল আলোচিত প্রশ্নের অবতারণা করেন নিহান এবারে। ‘বিয়ের পর ছেলেরা বদলে যায়’—এ ব্যাপারে সবার মতামত জানতে চাওয়া হয়। লোরা বলেন, ‘বিয়ের পর আমিও বদলে গেছি।’ আফরিন বলেন, আসলে মূল বিষয়টি হলো একে অপরের ভালো দিকগুলোর স্বীকৃতি জানানো ও প্রশংসা করা। বদলে গেলেও একে অপরকে অ্যাপ্রিশিয়েট করা জরুরি।

এই বিশেষ দিবসে ছেলেদের কাছ থেকে কোন বিষয়টি চান এই তিন তরুণী, জানতে চাইলেন নিহান এবার।

আফরিন হেসে বলেন, ‘আমার লিস্ট অনেক লম্বা হবে। তবে একে অপরকে সম্মান করা। কারণ, এটা কম দেখা যায়। আমার মনে ব্যাপারটি থাকা খুব জরুরি।’ লোরা অবশ্য এ ক্ষেত্রে খুব বাস্তবসম্মত কিছু বিষয় তুলে ধরে বলেন, ছেলেদের জন্য অনেক কিছু সহজ। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের নিজেদের একই অবস্থানে আনতে দ্বিগুণ কাজ করতে হয়।

মাসুদা খান
মাসুদা খান

মাসুদা তাঁর স্বভাবসুলভ ‘মাসু আঁকে’র অবতারে মজাচ্ছলে বললেন, অত্যন্ত জরুরি এক বিষয়, যা নিয়ে আসলে কথা হয় না। তিনি বললেন, অনেক কাজ ছেলেরা করে ফেলে, যা ভালো নয়। যেমন রাস্তার পাশে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া। বাসায় গিয়ে বা যথাযথ স্থানে গিয়ে তা করতে হবে। লোরা বললেন, মেয়ে তো এই কাজ করে না। মেয়েরা যদি পারে, তবে ছেলেরা নয় কেন।

আবারও এল আড্ডার ছলে এক মজার প্রসঙ্গ। নিহান হাসতে হাসতে বললেন, ‘মেয়েরা কেন প্রেমের প্রস্তাব দেয় না, ছেলেদের কেন করতে হবে কাজটি?’

মাসুদা বেশ সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিলেন, ‘না, এমন সব সময় হয় না। আমি ভালো লাগলে প্রেম নিবেদন করেছি তো।’ এবার সবাই হেসে ওঠেন সমস্বরে। মাসু আঁকের মাসু ছেলেমানুষি ভঙ্গিমায় বলেন, ‘আসলে ছেলেরা তো সুন্দর। আমার ছেলেদের হাসি ভালো লাগে।’ আবারও সম্মিলিত হাসি।

নিহান কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদে ফেলার ভান করে বললেন, ‘আমি খুশিতে কেঁদে ফেলব। পৃথিবীতে তো কেউ ছেলেদের এভাবে সুন্দর বলেনি।’

হাসতে হাসতে আফরিন বলেন, ‘তোমার তো পুরুষ দিবস উদ্‌যাপন হয়ে গেল।’ লোরা তখন বলেন, তাঁকে কেউ প্রশংসা করলে খুশি হয়ে যান তিনি। জানালেন, প্রস্তাবটি তিনি দিয়েছিলেন তাঁর স্বামীকে। আফরিন অবশ্য বললেন, তাঁর অনুভূতির প্রকাশে তিনি এত স্বচ্ছন্দ নন, সহজে বলতে পারেন না। মাসুদার মজার মজার কথার খই ফুটছিল। বললেন, ‘তবে এভাবে বলার একটা খারাপ দিক হলো, এতে মেয়েটিকে ছেলেটি পাত্তা দেওয়া কমিয়ে দেয়। আর না বললে মেয়েটিকে বেশি পাত্তা দেয় ছেলেরা।’

ছেলেরা নিজেদের জন্য কিছু না কিনে পরিবারের কথা আগে ভাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে লোরা বলেন অন্য কথা। বললেন, ‘ছেলেরা হাই মেইনটেন্যান্স হতে পারে। কিছু পছন্দ হলে তারা কিনতে পারে। নিজের সবকিছু কারও জন্য ত্যাগ করা জরুরি নয়।’ আফরিন মনে করেন, ‘এটি এখন আর আগের মতো নেই। ছেলেরা নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য দেয়।’ আড্ডার শেষ পর্যায়ে প্রশ্ন এল, আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস উপলক্ষে কে কী বলতে চান।

আফরিনই শুরু করলেন। বললেন, ‘আসলে এখানে বলার বেশি কিছু নেই। সমাজ নারী বা পুরুষ কাউকে ছাড়া চলে না।’ মজা করে যোগ করলেন, ‘ছেলেদের ছাড়া তো জীবন খুব বোরিং হয়ে যাবে। আর আমরা বোরিং জীবন চাই না।’ এবার হেসে দিলেন সবাই।

মাসুদা বললেন, ‘আজ যেহেতু আমাদের আলোচনার বিষয়—পুরুষের পাশে। তাই আমি বলতে চাই, পুরুষের পাশে আমরা থাকতে চাই। তবে এ জন্য একে অপরকে সম্মান করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ লোরা বললেন আরেক গুরুত্বপূর্ণ কথা, ‘আমার মনে হয় ছেলেদের এত শক্ত ইমেজ নিয়ে থাকার কিছু নেই।’ দিন শেষে পুরুষেরাও আবেগপ্রবণ হন, তাঁদেরও আছে অনুভূতি আর ভালো লাগা-মন্দ লাগা।

পুরুষের পাশে নারী আছেন সর্বান্তকরণে—আজকের মজার আড্ডায় এই চিরসত্য আবারও উঠে এল চিরন্তনরূপে। তবে তালি বাজাতে হবে দুই হাতেই।

ট্রান্সিক্রপশন: নাদিমা জাহান ও রিফাত পারভীন

ছবি: হাল ফ্যাশন

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২২, ১৪: ৪০
বিজ্ঞাপন