নারীরা কেন এখন মেয়েলি চেহারার পুরুষের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমাদের সমাজে একটা সাধারণ ধারণা আছে যে, মেয়েরা নাকি মাচো চেহারার ছেলেদেরই বেশি পছন্দ করে। এর মানে হল মোটা ভ্রু, কড়া দৃষ্টি, শক্ত চোয়াল এই রকম পুরুষালি চেহারার ছেলেরাই বেশি আকর্ষণীয় হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়। সদ্য কৈশোর পার করা ছেলেটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে ভাবে, আমার চোয়ালটা কি শক্ত? চোখে কি আমার সেই কড়া দৃষ্টি আছে? কারণ, চারপাশের সমাজ, সিনেমা, বিজ্ঞাপন সবকিছুতেই এখন বারবার বোঝানো হয় যে, একজন পুরুষ যতটা কঠিন চেহারার, ততটাই সে আকর্ষণীয়।

কোমল মুখশ্রী এখন বেশি টানছে নারীদের
কোমল মুখশ্রী এখন বেশি টানছে নারীদের

কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন যে, এই ধারণা এখন আর আধুনিক সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক সাড়াজাগানো স্টাডির পরিসংখ্যান বলছে, নারীরা এখন মাচো চেহারার চাইতে কোমল মুখশ্রীর ছেলেদের দিকেই বেশি আকৃষ্ট হন। চলুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

বিজ্ঞাপন

গবেষণায় যা দেখা গেছে

যুক্তরাজ্য ও জাপানে ১,৫০০ অংশগ্রহণকারীর ওপর সাম্প্রতিক সময়ের এই স্টাডিতে চালানো হয় একটি চমকপ্রদ মনোবিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা। প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে দেখানো হয় একই পুরুষের দুটি সংস্করণ। যেখানে একটি ছবিতে পুরুষের চেহারায় রাখা হয়েছিল কঠিন ও পুরুষালি ভাব, যেমন মোটা ভ্রু, ধারালো চোয়াল আর কড়া চোখের রেখা। আরেকটি ছবিতে ছিল এর ঠিক একেবারে উল্টা অবস্থা। পুরুষের চেহারায় ছিল কোমল, মিষ্টি ভাব, পাতলা ঠোঁট, বড় বড় চোখ আর নরম মুখাকৃতি। তারপর তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন মুখশ্রীটা আপনাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। এই গবেষণার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। অধিকাংশ মানুষই বেছে নিয়েছেন সেই মুখ, যা ছিল কোমল এবং তুলনামূলকভাবে বেশি মেয়েলি।

ম্যাচোইজম নয়, সংবেদনশীলতাই এখন আকর্ষণের মাপকাঠি
ম্যাচোইজম নয়, সংবেদনশীলতাই এখন আকর্ষণের মাপকাঠি

কেন এমন হলো

গবেষকরা বলছেন, মানুষের চেহারার কোমলতা বা মিষ্টতা আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে। আমরা ধরে নিই, যাদের মুখশ্রী নরম ও মায়াবী, তাঁরা নিশ্চয়ই ভালো স্বভাবের, বিশ্বাসযোগ্য, সহজে মিশতে পারে, এমনকি জীবনে সফলও হতে পারে। এটা কিন্তু শুধুই বাস্তব অভিজ্ঞতা নয়, আমাদের মনের ভেতরে গেঁথে থাকা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা। আর এই মনোভাবকে বলা হয় হেইলো এফেক্ট। মানে, কারও কোনো একটি গুণ বা চেহারার একটা দিক আমাদের ভালো লাগলে, আমরা তার সব কিছুই ভালো ভাবতে শুরু করি। যেমন, কারও চেহারা মিষ্টি লাগলে আমরা ধরে নিই সে ভালো মানুষ, বন্ধুত্বপূর্ণ, এমনকি বিশ্বাসযোগ্য। এটাই হলো এই এফেক্টের জাদু। আসলে চকলেট বয় ধরনের ছেলেদের প্রতি সবসময়ই মেয়েদের এক আলাদা আকর্ষণ থাকে। ইনোসেন্ট মুখশ্রী, মিষ্টি হাসি আর ক্লিন শেভ করা হলিউড হিরো টম ক্রুজ, ব্র্যাড পিট, লিওনার্ডো ডিক্যাপ্রিও থেকে শুরু করে বলিউডের আমির খান, তরুণ বয়সের শহিদ কাপুরের মতো লুকস আছে এমন ছেলেরা সবসময় মেয়েদের পছন্দের তালিকায় থাকে। তবে এই সময়ে এসে এই বিষয়টি এত বেশি প্রাধান্য পাওয়ার কারণ হয়তো সবাই মন খুলে মতামত দিতে কুন্ঠাবোধ না করা। স্টেরিওটাইপ ভেঙে, ছেলেদের বাধ্যতামূলক ম্যাচো ইমেজ থেকে বেরিয়ে তারাও এখন নিজেদের মনমতো করে গ্রুমিং করছে নিজেকে। অ্যাস্থেটিক দিকে নজর দিচ্ছে ছেলেরা আর নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করছে। ক্রমবর্ধমান কে-পপ আর কে-ড্রামা কালচারও অবশ্য আমাদের মতো দেশে ছেলেদেরকে কিছুটা মেয়েলি লুক নিতে উদ্বুদ্ধ করছে। কারণ আমাদের মেয়েরা এখন তেমন ছেলেই পছন্দ করে।

বিজ্ঞাপন

এই নতুন গবেষণার নেতৃত্বে থাকা ড. থোরা বিয়র্নসডটির ও তাঁর দল বিষয়টিকে দেখেছেন আরও বড় পরিসরে। এখানে দেখা যায়, আকর্ষণ বা সৌন্দর্যের অনুভূতি এখন আর কেবল কিছু প্রচলিত ধারণার মধ্যে আটকে নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যাচ্ছে, এবং সৌন্দর্যের সংজ্ঞা হচ্ছে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।

ছেলেদের বিউটি স্ট্যান্ডার্ড এখন আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক, সর্বজনীন
ছেলেদের বিউটি স্ট্যান্ডার্ড এখন আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক, সর্বজনীন

কোমলতার আবেদন: মনের কাছাকাছি আসার পথনারীসুলভ কমনীয় মুখশ্রী বা নরম চেহারার প্রতি মানুষের টান কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ নয়, বরং এর গভীরে একধরনের মানসিক প্রশান্তি, নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের অনুভব লুকিয়ে আছে। আমাদের মস্তিষ্ক এমন মুখশ্রীকে অনেক সময় ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রতীক হিসেবে দেখে। তখন দেখে মনে হয়, এই মানুষটি হয়তো বেশি সহানুভূতিশীল, বেশি অনুভূতিপ্রবণ, যার সঙ্গে সহজেই কথা বলা যায়, মনের কথা শেয়ার করা যায়।

এর ঠিক বিপরীতে, একজন অতিমাত্রায় মাচো বা কঠোর চেহারার মানুষকে আমরা অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে কঠিন, দুর্ভেদ্য, কিংবা আবেগ প্রকাশে অনাগ্রহী ভেবে থাকি। এমন মুখশ্রী হয়তো সুরক্ষার প্রতীক হতে পারে, কিন্তু মানসিক ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে একধরনের দূরত্বও তৈরি করতে পারে। বর্তমান সময়ের সম্পর্কের বাস্তবতায়, যেখানে মানুষ খোঁজে বোঝাপড়া, ভালোবাসার অভিব্যক্তি, সহানুভূতি ও সমমর্মিতা সেখানে এই 'কোমল মুখশ্রী' এক নতুন ধরনের আকর্ষণের ভাষা হয়ে উঠছে। এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাই প্রমাণ করে যে, মানুষ এখন কেবল বাহ্যিক দৃঢ়তায় নয়, বরং অভ্যন্তরীণ সংবেদনশীলতায় বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে।

আসল আকর্ষণ লুকিয়ে থাকে সেই মুখেই, যেটা মনের কাছাকাছি আসতে পারে
আসল আকর্ষণ লুকিয়ে থাকে সেই মুখেই, যেটা মনের কাছাকাছি আসতে পারে

এই গবেষণা শুধু সৌন্দর্যবোধের একটি নতুন দিক উন্মোচন করেনি, বরং আমাদের সামাজিক চেতনার বদলে যাওয়া প্রতিফলনও তুলে ধরেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে শিখছি যে, আকর্ষণ কেবল বাহ্যিক গঠন নয়, বরং মনের ভাষাও। কঠোরতার বদলে এখন নারীরা খুঁজছে উষ্ণতা, দূরত্বের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে উঠেছে সংযোগ। তাই যদি আপনার চেহারায় থাকে কোমলতা বা নারীসুলভ কমনীয়তার ছাপ, চিন্তার কিছু নেই এটাই হতে পারে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। কারণ আসল আকর্ষণ লুকিয়ে থাকে সেই মুখেই, যেটা মনের কাছাকাছি আসতে পারে।

তথ্যসূত্র: টেন প্লে

ছবি: পেকজেলস ডট কম

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫, ০০: ৫৭
বিজ্ঞাপন