পৃথিবীর সবচেয়ে নিখাদ, নির্ভেজাল সম্পর্কগুলোর তালিকা করলে বন্ধুত্ব নিঃসন্দেহে থাকবে সেই তালিকার একেবারে ওপরের দিকে। বন্ধুত্ব মানেই তো নির্ভরতা, নিঃশর্ত ভালোবাসা, আর একসঙ্গে বেড়ে ওঠার গল্প।
ছোটবেলায় স্কুলব্যাগের মতোই সঙ্গী হয় বন্ধুরা। প্রতিদিনের হাসি, কান্না, ঝগড়া—সবকিছুতেই থাকে বন্ধুদের ছোঁয়া। কিন্তু বয়স বাড়তেই যেন তাঁরা কোথায় মিলিয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন আসে না, কেন এমন হয়? আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের গতি বদলায়। ক্যারিয়ার, পরিবার, দায়িত্ব—সবকিছুই যেন সময় আর অনুভূতির জায়গা দখল করে নেয়।
সময়ের অভাব, যোগাযোগ ঘাটতিতে আমরা নিজের অজান্তেই দূরে সরে যাই প্রিয় মুখগুলো থেকে। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কেন বয়স বাড়ার সঙ্গে আমাদের বন্ধুর সংখ্যা কমে আসে?
১. সম্পর্কের চেয়ে ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ
শৈশবে ভবিষ্যতের চিন্তা খুব একটা মাথায় ঘুরপাক খায় না। তখন বন্ধুত্ব থাকে সাদামাটা এবং অনেকটাই নিঃস্বার্থ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যারিয়ার, আর্থিক নিরাপত্তা, নিজের অবস্থান তৈরির তাগিদ অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। চাকরি বা ব্যবসার পেছনে প্রতিনিয়ত লেগে থাকতে হয়, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। এমন সময়ে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা অনেকেই অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা মনে করতে শুরু করেন। যদিও সম্পর্ক গড়ে তুলতে সময় লাগে, কিন্তু হারিয়ে যেতে সময় লাগে না। আর এই ব্যস্ততার ফাঁকেই অনেক বন্ধুত্ব হারিয়ে যায় অতীতের পাতায়।
২.বন্ধুদের জন্য সময় বের না করা
শৈশব কিংবা কৈশোরে বন্ধুদের জন্য সময় বের করার কোনো দরকার হতো না। বেশির ভাব সময় কাটতোই বন্ধুদের সঙ্গে। স্কুল বা কলেজে বিশাল একটি সময় বরাদ্দই থাকতো তাঁদের জন্য। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সময় কমে আসে! সময় বের করতে হয়, পরিকল্পনা করতে হয়। নানা দায়-দায়িত্ব, ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর পর অনেকেই এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে পছন্দ করেন না। কিন্তু বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁদের জন্য সময় বের করা অত্যন্ত জরুরি। সময় না দিলে বন্ধুত্বের এই বন্ধন আলগা হতে থাকে। কথায় আছে, চোখের আড়াল, তো মনের আড়াল।
৩.একতরফা সম্পর্ক
বন্ধুত্ব তখনই টিকে থাকে, যখন তা দুইপক্ষ থেকেই লালন করা হয়। আমরা মনে করি, শুধু প্রেমের সম্পর্কগুলোই একতরফা হয়, কিন্তু অনেক সময় আমাদের বন্ধুত্বগুলোও একতরফা হতে পারে। যখন দেখবেন একপাক্ষিকভাবে একজন সবসময় খোঁজ নিচ্ছে, মেসেজ করছে, ফোন দিচ্ছে, অন্যজন শুধু ব্যস্ততার অজুহাত দিচ্ছে—তখনই সম্পর্কটি ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। একসময় গিয়ে এটি হয়ে যায় দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনের মতো। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহ হারায়, সম্পর্ক মলিন হয়ে পড়ে। আর দীর্ঘদিন ধরে এমন একতরফা চেষ্টায় একজন ক্লান্ত হয়ে এক সময় থেমে যায়। যেহেতু সম্পর্কটি একতরফা, তাই একজন থেমে গেলে এটি সেখানেই শেষ হয়ে যায়।
৪. আবেগের প্রকাশ কমে যাওয়া
বন্ধুত্বের মধ্যে যতই গভীরতা থাকুক না কেন, মাঝে মাঝে সেই বন্ধুকে এটি জানিয়ে দেওয়া জরুরি, সে এখনো আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনার জীবনে তাঁর জায়গাটি অটুট। কিন্তু অনেকেই ভাবে এসবের কী দরকার সে তো জানেই সে আমার কাছের বন্ধু। এখানেই মূলত আমরা সবচেয়ে বড় ভুল করে বসি। এই না-বলা ভাবনাই সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে। ভালোবাসা, অনুভূতি, গুরুত্ব—সবকিছু প্রকাশ করতে হয় শব্দে, আচরণে ও ব্যবহারে। তা নাহলে মানুষটি এক সময় মনে করতে শুরু করে, তাঁর আর তেমন গুরুত্ব নেই আপনার জীবনে।
৫. অভিমান ও ক্ষমা করতে না পারা
একসঙ্গে চলতে গেলে অনেক মান অভিমান চলতেই থাকে। সম্পর্কটি গুরুত্বপূর্ণ নাকি, এই ক্ষুদ্রতর মান অভিমান গুরুত্বপূর্ণ, এটি বুঝতে হবে। অনেকেই সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেন, আবার অনেকেই এসব ক্ষুদ্র মান অভিমানকে৷ সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে যদি সম্পর্ক ভেঙে পড়ে, তাহলে সেটার শেকড় খুব একটা মজবুত ছিল না। সব সম্পর্কেই ভুল হয়, মতের অমিল হয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—ভুল মেনে নিতে শেখা এবং ক্ষমা করতে ও চাইতে শেখা। কেউ যদি নিজের ভুল বুঝতে পারে তাহলে তাঁকে ক্ষমা করতে শেখা উচিত। কোনো মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। বন্ধুত্ব মানেই তো নির্ভেজাল সম্পর্ক, সেখানে অহংকার রাখার জায়গা নেই। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কেউ অভিমান পুষে রাখে, অন্যজন ক্ষমা চাইতে চায় না—এই দূরত্ব ক্রমে এমন জায়গায় পৌঁছায়, যেখান থেকে ফেরত আসা মুশকিল হয়ে পড়ে।
সূত্র: থট ক্যাটালগ, মানি কন্ট্রোল
ছবি: পেকজেলস