পৃথিবীতে এমন কে আছে যে সমৃদ্ধি চায় না, অর্থসম্পদ চায় না, নিজেকে আরেক ধাপ ওপরে দেখতে চায় না? আমি আরেকভাবে প্রশ্ন করি, আপনি কি নিজেকে গরিব দেখতে চান? উত্তরে সবাই হয়তো বলবেন যে না, নিজেকে দরিদ্র দেখতে চান না। কিন্তু আমি যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি যে আপনি কি নিজেকে লোভী হিসেবে দেখতে চান? উত্তরে সবাই হয়তো বলবেন যে না, নিজেকে লোভী হিসেবে দেখতে চান না।
অথচ বলা হয়ে থাকে যে টাকাওয়ালা মানুষ মাত্রই লোভী। অর্থই অনর্থের মূল। মানুষকে বলা হয় সে টাকার কাঙাল, বলা হয় সে লোভী, মানুষকে বলা হয় সে স্বার্থপর—কারণ সে টাকা নিয়ে চিন্তা করে। নিজেকে ভালো অবস্থায় দেখতে চাওয়া কি খারাপ? কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে মানুষ বেশি টাকা অর্জন করতে পারে না।
বুঝতেই পারছেন আজ আমি লিখছি টাকা নিয়ে আমাদের চিন্তা এবং টাকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে। আমি গত লেখাতে লিখেছি আমার নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে এবং আমি রিফিউজি হোম বা শেল্টার হোমে ছিলাম, আমার অনেক পরিশ্রমের ফলে অর্জন করা সব কিছু হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাহলে আমি কীভাবে আবার ঘুরে দাঁড়ালাম? কীভাবে শূন্য থেকে আবার শুরু করলাম? আমি লিখেছিলাম যে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত যে মেন্টররা ছিলেন বা আছেন, তাঁদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। কারণ, আমি বিশ্বাস করি যে আমি যদি পৃথিবীর বেস্ট মানুষ, সফল মানুষ, বিখ্যাত মেন্টরদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে আমার জীবনও তাঁদের মতো সমৃদ্ধিশালী হবে। আমি কী বা আপনি কী তার ৭৫ ভাগ নির্ভর করে আমার বা আপনার আশপাশের মানুষের ওপর, বন্ধুবান্ধবের ওপর, শিক্ষকের ওপর, সহকর্মীদের ওপর—কারণ তাদের থেকে আপনি কী মেসেজ নিচ্ছেন, তার ওপর। আর ৯৫ ভাগ নির্ভর করে আপনার নিজের ওপর।
আমরা যখন প্রতিটি কথা শুনি তার ওপর আমাদের অবচেতন মন একটি করে সিদ্ধান্ত তৈরি করে, একটি করে বিশ্বাস তৈরি করে। তার ওপর নির্ভর করে একটি মানুষ কীভাবে রেসপন্স করবে? আপনি কি ইজি গোয়িং একজন মানুষ হবেন নাকি আপনি সিরিয়াস ধরনের মানুষ হবেন। আপনি কি সব কাজে সফলতা পাবেন নাকি নিজেকে পরাজিত দেখতেই অভ্যস্ত হবেন? আপাতদৃষ্টে আপনি বলতে পারেন যে আমি কেন নিজেকে পরাজিত দেখতে চাইব? আমি নিজেকে সফল দেখতে চাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে ৯৫ ভাগ মানুষই জীবনের কোনো না কোনো স্তরে এসে ভাবে যে আমি তো এসব ডিজার্ভ করি না, আমি তো এসবের যোগ্য নই। আমার নিজেকে নিয়ে নিজের ভাবনাও তেমন ছিল।
আমি ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে চলে গেলাম, ভালো চাকরি পেলাম, ভালো বিয়ে হলো, সুন্দর বাচ্চা হলো—সবকিছু এত সহজ আর সুন্দরভাবে চলছিল যে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা আমার জীবন। কারণ, আমার জীবন তো ছিল কঠিন কষ্ট আর অপমানে ভরা। ফলে আমার অবচেতন মন নিজের ভেতর থেকে এসব কিছুকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য একটি প্রোগ্রাম পরিচালনা শুরু করে। এমন সব মানুষকে আমার জীবনে হাজির করা শুরু করল যে যারা আমার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য একজোট হয়ে কাজ করা শুরু করল।
এ রকম ঘটনা আপনাদের জীবনেও ঘটে থাকে। অনেক কষ্টের পর যখন কিছু জিনিস অর্জন করেন, তারপর কেউ আসে জীবনে বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, যার ফলে আপনি আবার সবকিছু হারিয়ে ফেলেন। হারানোর পর আবার কঠিন পরিশ্রম করেন আবার সবকিছু অর্জন করেন এবং আবার আবিষ্কার করেন যে আপনার জীবনে একই ধরনের মানুষ আবার আসা শুরু করেছে; সে হয়তো আপনার বন্ধু সেজে বা আপনার বস বা সহকর্মীর পরিচয়ে। এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আপনার অবচেতন মনের প্রোগ্রামগুলোকে পরিবর্তন করে নতুন প্রোগ্রাম বসাতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই তা জানে না। মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অথচ নিজের সাবকনশাস মাইন্ডের প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে কনশাস মাইন্ডকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করে না।
আমি তো সব হারিয়ে নিঃস্ব ছিলাম। তাহলে এত সব দামি দামি কোর্স আমি কীভাবে করার সুযোগ পেলাম? তার একটা বড় কারণ হলো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমি এদের সবার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেব। আপনি যে মুহূর্ত থেকে বদ্ধমূল সিদ্ধান্ত নেবেন যে আপনি কোনো কিছু করবেন, পুরো ইউনিভার্স আপনাকে তা পাইয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। আমি শত শত স্কলারশিপ মেনিফেস্ট করেছি। আমি বাংলাদেশে কোনো দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারিনি; কারণ আমার বাবার সেই পরিমাণ টাকা ছিল না। অথচ আমি ইংল্যান্ডে একের পর ডিগ্রি নিয়েছি সব স্কলারশিপ পেয়ে।
আমি শুধু নিউট্রেশনের ওপর তিনটি মাস্টার্স ডিগ্রি করেছি সব স্কলারশিপ পেয়ে; এগুলোর একেকটি কোর্স ফি এক বছরে ছিল ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে। আমি পিএইচডির জন্য স্কলারশিপ পেয়েছিলাম, যার অর্থমূল্য ছিল প্রায় ৭৫ লাখ টাকা; যদিও আমি তা শেষ করতে পারিনি আমার ছেলের অসুস্থতার জন্য। ইংল্যান্ডে আমি প্রায় ২০টি বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছি, যে জন্য আমি এত বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে পারি এবং সবকিছু আমি স্কলারশিপ পেয়ে পড়েছি, যার মূল্য হবে কয়েক কোটি টাকা; যার ফলে আজ আমি হারলে স্ট্রিটের মতো জায়গায় কাজ করতে পারি।
আমার টাকা ছিল না কিন্তু নিজেকে বিশ্বের কাছে প্রমাণিত করার অদম্য ইচ্ছা ছিল। আমি চেষ্টা করে গেছি এবং সৃষ্টিকর্তা এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, প্রকৃতি আমাকে সাহায্য করে গেছে। আমি এমন সব মেন্টরের কাছ থেকে স্কলারশিপ পেয়েছি, যাদের প্রোগ্রামে শুধু বিলিয়নিয়াররাই যেতে পারত এবং কোনো কারণে মেন্টর সেই বছর একটি ফ্রি স্কলারশিপ দিয়েছেন এবং লটারি করেছেন, সেই লটারিতে আমার নাম এসেছে। তার পরের বছর ওই মেন্টর মারা গেছেন। ফলে আমিই একমাত্র ছাত্রী, যে সেই দামি কোর্স বিনা মূল্যে করার সুযোগ পেয়েছি। এতে করে কোটিপতি মানুষদের চিন্তাধারাকে বোঝার সুযোগ পেয়েছি।
আমি অবাক হয়ে দেখেছি তারা সবাই মাইন্ডসেটকেই প্রাধান্য দেয় এবং তাদের সবার মাইন্ডসেট মেন্টর আছে। তাদের বেশির ভাগই শূন্য থেকে শুরু করেছে এবং তারা সবাই বিশ্বাস করে যে ‘মানি ইজ অ্যান এনার্জি’। আমরা মানুষেরা, এই প্রকৃতি, সবকিছু যেমন শক্তি, তেমনি অর্থও হলো শক্তি। এই শক্তি পাওয়ার জন্য আপনাকে মানসিকভাবে যেমন সুস্থ থাকতে হবে, তেমনি প্রয়োজন শারীরিক ফিটনেস। যে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে যত বেশি পজিটিভ, তার জীবনে অর্থের আবির্ভাব তত বেশি।
শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা থাকলে অর্থ খরচ করা শুরু হয়। আর অর্থ খরচ তো করতেই হবে; কারণ অর্থ আসেই খরচ হওয়ার জন্য। তবে আপনি কি সেই অর্থ দিয়ে বাড়ি কিনতে পারছেন, নাকি হলি ডে এনজয় করছেন, নাকি চিকিৎসার জন্য খরচ করছেন, নাকি শেয়ারবাজারে বা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ইনভেস্ট করে লস নিয়ে বসে আছেন, নাকি আমার মতো কোচদের বা মেন্টরদের হায়ার করছেন, তা নির্ভর করবে আপনার সঙ্গে টাকার কী সম্পর্ক তার ওপর।
আমি ক্যানসার রোগীদের ওপর কাজ করি। আমার একজন রোগী যিনি স্টেজ ফোর ব্লাড ক্যানসার নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি গত দুই বছর আমেরিকাতে ফ্রি ট্রিটমেন্ট পেয়েছেন, যার অর্থমূল্য এক মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৩ কোটি টাকা। আমেরিকাতে স্বাস্থ্যসেবা নির্ভর করে ইনস্যুরেন্সের ওপর। যার আর্থিক অবস্থা যত ভালো, তিনি তত ভালো ইনস্যুরেন্স কাভার পান। আমার ক্লায়েন্ট এমন সব ট্রিটমেন্টের জন্য ইনস্যুরেন্স কাভার পেয়েছিলেন, যা কেবল বিলিয়নিয়াররাই পেয়ে থাকেন। এটা একটা মিরাকল। তিনি কোনো রকমের সাইড এফেক্ট ছাড়া ক্যানসার–ফ্রি হয়ে বেঁচে ফিরেছেন। আমি শুধু তার খাবার আর মাইন্ডসেটের ওপর কাজ করে গেছি। আজকে প্রথম পর্ব লিখলাম। আমার লেখা পড়তে থাকুন। পরের পর্বে আরও বিস্তারিত লিখব। কোনো প্রশ্ন থাকলে ই–মেইল করুন।
লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিক এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ই–মেইল: [email protected]
ছবি: পেকজেলসডটকম