মুনতাহা আক্তার জেরিন। ফুটফুটে মুখের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে ৩ নভেম্বর থেকে। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে। বাড়ির পাশের পুকুর থেকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হয় তার মৃতদেহ। শিশুটি নিখোঁজের পর থেকে পরিবার দাবি করে আসছিল, পরিকল্পিতভাবে মুনতাহাকে অপহরণ করা হয়েছে। দুই প্রতিবেশীকে সন্দেহ করা হচ্ছে তার এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে।
শিশু মুনতাহার এই মৃত্যু নাড়া দিয়ে গেছে অভিভাবকদের। খবরটি দেখার পর বাচ্চাদের একবার হলেও জড়িয়ে ধরেছেন মায়েরা। এ ধরনের ঘটনা সত্যি সবাইকে ভাবিয়ে তোলে বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়ে। চলুন জেনে নিই আমাদের বাচ্চাদের নিরাপদ রাখতে কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে পারি আমরা।
বাচ্চারা খেলতে ও সময় কাটাতে পারে এমন কিছু নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি করে দেওয়া। বাচ্চারা একটু বড় হয়ে উঠলেই তারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ হয়ে ওঠে। তাদের জন্য অভিভাবকেরা চাইলে নির্দিষ্ট কিছু শপিং মল, পার্ক, থিয়েটার ও লাইব্রেরির পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। এতে অভিভাবকরা তাকে সহজেই খুঁজে পেতে পারেন।
ছোট পরিবারগুলোতে মা–বাবা দুজনই কর্মজীবী হলে বাচ্চাদের জন্য কেয়ারগিভার প্রয়োজন হয়। নিয়োগ দেওয়ার আগে তাদের প্রোফাইল ভালো করে যাচাই করে নেওয়া। আর সব তথ্য নিজেদের কাছে রাখা।
অপরিচিতদের সঙ্গে বাচ্চারা কতটুকু মিশতে পারে সে বিষয়ে তাদের আগে থেকেই বুঝিয়ে বলা। প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে, পার্কে খেলার সময় ও রাস্তাঘাটে চলাচলের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নিয়ম শিখিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যাতে করে সম্ভাব্য বিপদগুলো থেকে তারা ছোটবেলা থেকেই সাবধান হতে পারে।
১. বাসা থেকে বের হওয়ার আগে অভিভাবককে জানিয়ে বের হওয়ার চর্চা করানো।
২. ‘ব্যাড টাচ’ ও জোরজবরদস্তি নিয়ে তাদের সচেতন করা। এমন আচরণ কেউ করলে চিৎকার করা বা দৌড়ে পালাতে বলা।
৩. অপরিচিতদের থেকে কিছু গ্রহণ না করা।
৪. নাম–ঠিকানাসহ কিছু প্রয়োজনীয় নম্বর শিখিয়ে রাখা। মা–বাবার ফোন নম্বর আর স্থানীয় ইমার্জেন্সি নম্বর যেমন ৯৯৯-এর ব্যাপারে জানিয়ে রাখা।
৫. মার্কেট, সুপারমল কিংবা যেকোনো বিল্ডিংয়ের ইমার্জেন্সিতে করণীয় শিখিয়ে রাখা।
৬. বন্ধুদের বাড়ি সম্পর্কে জানা এবং কোন প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাচ্চা মেশে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা।
৫. আর শিশু যদি বাসায় একা থাকে তাহলে তাকে দরজা-জানালার লক কীভাবে করতে হয়, কখন দরজা খুলবে, কখন খুলবে না, সেই ব্যাপারগুলো শিখিয়ে রাখা।
এ নিয়ে কথা হয় ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট তামিমা তানজিনের সঙ্গে। তিনি বেশ কিছু বিষয়ে আলোকপাত করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বাচ্চার আস্থার জায়গায়। অভিভাবকদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, যেটাই হোক না কেন মা–বাবা তার পাশে আছে। তাহলেই বাচ্চারা খুব সহজেই তাদের কাছে মন খুলে কথা বলতে পারে। যেটাই ঘটবে সেটাই শেয়ার করবে।
তামিমা তানজিন বলেন, ‘আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলে থাকি, মা–বাবা হবে বেস্ট ফ্রেন্ড। আসলে সেটা নয়, মা–বাবাকে হতে হবে সহজ ও কমফোর্টেবল প্যারেন্ট। যাতে বাচ্চারা মন খুলে সব শেয়ার করতে পারে। আর এই আস্থা তৈরি হলে বাচ্চারা মা–বাবার কাছে অনায়াস হবে।’
আরও একটি বিষয়ে তাঁর পরামর্শ হলো, সমস্যা সমাধানের কৌশলী হতে হবে। ছোটখাটো কোনো বিষয়কে নিয়ে অধিক উত্তেজনার প্রয়োজন নেই। তিলকে তাল করলে বাচ্চা ঘাবড়ে যাবে। বরং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, কৌশলী হয়ে সমাধানই শ্রেয়। কারণ, বেশি উত্তেজনায় বাচ্চা ভয় পাবে। পরে আর সে কোনো কিছুই শেয়ার করবে না। তাতে হিতে বিপরীত হবে।
মা–বাবারা আবেগপ্রবণ হয়েই থাকেন সন্তানের ব্যাপারে। তবে তাঁদের ইমোশনাল না হয়ে বরং ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সকে কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন যথাযথ প্যারেন্টিং ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট।
আরও একটি বিষয়ে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর সেটা হলো, এটাও নিশ্চিত করতে হবে, যেন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাচ্চার ইচ্ছা অগ্রাধিকার পায়। অর্থাৎ, সে যা বলবে মা–বাবা সেটাই করবে।
মুনতাহার ক্ষেত্রে বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আর এটা হতে পারে যেকোনো মা–বাবার জন্য শিক্ষা। কারণ, এমন কিছু করা যাবে না যাতে যাতে হিংসাপ্রবণ, আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। গৃহশিক্ষক, আয়া ইত্যাদি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যেমন বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা প্রয়োজন তাদের হ্যান্ডল করার ক্ষেত্রে, তাদের রাখা ও না–রাখার ক্ষেত্রেও একইভাবে কৌশলী হতে হবে। কারণ এখন মনে হতেই পারে, শিক্ষকের আচরণ কি খেয়াল রাখা হয়েছিল কিংবা মুনতাহা কি তার বাবা–মাকে কিছু শেয়ার করেছিল শিক্ষকের আচরণের অসঙ্গতি নিয়ে।
ছবি: প্রথম আলো ও পেকজেলসডটকম