ঘোর বর্ষাকাল। হুট করে দমকা বাতাস আসে। শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। মা তখন ছোটাছুটি করে বারান্দায় মেলে দেওয়া কাপড় তুলতে চলে যায়। বাতাসের দমকে ঠাস করে দরজা বন্ধ হয়ে! শুরু হয় কান ফাটানো বজ্রপাতের শব্দ। এত সব চমকে দেওয়া শব্দে পুঁচকি একেবারেই দিশাহারা হয়ে যায়। এমনিতেই বিড়ালের তীব্র শ্রবণশক্তি নিয়ে দ্বিমত করার কিছু নেই। বিড়াল খুব স্পষ্টভাবে টের পায় অধিকাংশ অত্যন্ত মৃদু শব্দ। প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলেন, বিড়ালের মধ্যকর্ণের গঠনের সঙ্গে মাথার সরু খুলির আকার—সব মিলিয়ে শব্দ বিড়ালের মস্তিষ্কে দ্রুত পৌঁছাতে সহায়তা করে। একই সঙ্গে ‘হাই পিচ’ এবং ‘লো পিচ’ শব্দ বিড়ালের কর্ণগোচর হয়। তাই তীব্র শব্দ তার আতঙ্কের কারণ হতে পারে।
পুঁচকি বাতাসে ঠাস করে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজার দিকে তাকায়, এরই মাঝে শোঁ শোঁ শব্দে দমকা বাতাসের শব্দও তার কানে আসে। তার চালচলনে দেখা যায় অস্থিরতা। বজ্রপাতের শব্দ হলেই সে ভয় পেয়ে মায়ের কাছে ছুটে যায়। বারান্দার কাছে যেতেই একপশলা বৃষ্টির ছাঁট এসে তার গায়ে লাগে। এক হাতে কাপড় আর এক হাতে সাবধানে পুঁচকিকে কোলে নিয়ে বারান্দার দরজা আটকে ঘরে চলে আসে মা। এই অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে এত ধরনের আচমকা শব্দই যে পুঁচকির ভয়ের কারণ, এটা মা বুঝতে পারেন। তাই তাকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন কিছুক্ষণ। এরপর জানালার পাশে বসিয়ে দেন, যাতে সে বুঝতে শেখে শব্দের উৎস কোথায়, অভ্যস্ত হয় ধীরে ধীরে।
একালের ফ্ল্যাটবাড়িতে জানালার কার্নিশ বলে কোনো কনসেপ্ট নেই। কিন্তু মা ঠিক বুদ্ধি করে একটা ছোট্ট স্টুল এমনভাবে জানালার পাশে সেট করে দেয়, যেন পুঁচকি বাইরে দেখতে পারে। বৃষ্টি-বাদল, রোদ–হাওয়ায় গাছের ডালের দোল খাওয়া সব কিছুই এই স্টুলে বসে দেখা যায়। এই জায়গাটা তার এক ধরনের কমফোর্ট জোনও বটে। এমনিতে বৃষ্টির দিনগুলোতে বিড়াল দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে কাটাতে পছন্দ করে। তবে তীব্র শব্দে যদি তার ঘুম ভেঙে যায়, সে আতঙ্কিত হয়। এ সময় তাকে স্পর্শ করে, পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া এবং মানুষের কাছাকাছি রাখা খুব দরকার যেন কোনোভাবেই বিড়ালের মধ্যে অ্যাংজাইটি না হয়। বয়স কম হলে তা আরও জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
কুকুর-বিড়াল সাধারণত কোনো কিছুর নিচে বা আড়ালে লুকিয়ে পড়ে ভয় পেলে। অনেকে নিজে নিজেই টেবিলের বা বিছানার নিচে—এ রকম পছন্দমতো একটি লুকানোর জায়গা বেছে নেয় শব্দজনিত উৎকণ্ঠা থেকে বাঁচতে। তা না হলে তার জন্য বেছে দেওয়া যায় নিরাপদ ও আরামদায়ক কোনো স্থান। এ সময় সবচেয়ে বেশি কার্যকর হলো সঙ্গ। কুকুর বা বিড়ালটিকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠে ভুলিয়ে রাখা যায় উৎকণ্ঠা আর ভয়ের কথা। আবার আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, ডিসেনসিটাইজিং। এর অর্থ হলো, বিভিন্ন জোরালো শব্দের রেকর্ড বাজিয়ে পোষা প্রাণীটিকে অভ্যস্ত করে তোলা।
মাঝে মধ্যে এদের কেউ কেউ আবার উপরে কম্বল বা কুশন–জাতীয় কিছু চাপিয়ে দিলে নিরাপদ বোধ করে শব্দজনিত ভয়ের সময়। তবে কুকুর-বিড়াল আগের কোনো ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বা ট্রমার কারণে নির্দিষ্ট কিছু শব্দের বিপরীতে বেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে পারে। সেক্ষেত্রে সে নিজেকে বা অন্য কাউকে যেন আঘাত না করে তা খেয়াল রাখতে হবে। আর যদি বিড়াল বা কুকুরের মধ্যে এই ভয় খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়; তার খাওয়া, খেলা ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, তবে অবশ্যই একজন পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কোনো দিন হয়তো কাকভেজা হয়ে মা বাড়ি ফেরে। ফিরেই দেখে, পুঁচকি ঝুলন্ত স্টুলে বসে খুব মন দিয়ে বৃষ্টি আর আকাশ দেখছে। জানালার কাচ বৃষ্টির জলে ঘোলা হয়ে আছে। মাকে দেখে সে এক লাফে ছুটে আসে কাছে, তার চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ কাচের মতো। সেখানে কোনো আতঙ্ক নেই। ঠিক সে সময় একঝলক রোদ ওঠে আকাশে।