
এ নক্ষত্রগুচ্ছ পৃথিবী থেকে প্রায় ৪৪০ আলোকবর্ষ দূরে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, এর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নরম গ্যাস ও ধূলিকণা মিলিয়ে এটি ধারণার চেয়ে ২০ গুণ বড়। খালি চোখে ছয়টি উজ্জ্বল তারা দেখা যায়, তবে আসলে হাজারো তারার সমাহার এটি। ৩১ ডিসেম্বর, প্রায় পূর্ণ চাঁদ প্লিয়াডিসের পাশ দিয়ে উজ্জ্বল হবে। খালি চোখে এটি ছোট নীল ঝলমলে গুচ্ছের মতো দেখা যাবে, আর বাইনোকুলার ব্যবহার করলে আরও স্পষ্ট দৃশ্য মিলবে। সন্ধ্যার এক থেকে তিন ঘণ্টা পর পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব আকাশের দিকে তাকালে এই চমকপ্রদ দৃশ্য সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। প্লিয়াডিস কেবল জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে নয়, মানুষের কল্পনা, মিথ ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। যাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন ‘কসমিক ওয়ান্ডার’।
গ্রিক ও রোমান পুরাণের সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক কিছুই জড়িত। সেভেন সিস্টার্সের পৌরাণিক গল্পটাও সেখাকার।
প্লিয়াডিস বা সাধারণভাবে ‘সেভেন সিস্টার্স’, উত্তর গোলার্ধের শীতকালে উজ্জ্বলভাবে দেখা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি হাজার বছরের বেশি সময় ধরে নজরে রাখা হয়েছে। সেল্টদের কাছে এটি ছিল টো টিউডেস বা স্ট্রেওইল এন, ফিলিপাইনের প্রাক্-ঔপনিবেশিক সমাজে মাপ লন বা মিউলো-পিউলো, হাওয়াইয়ানরা বলত মাকালাই, মাওরিদের কাছে মাতারিকি আর আরবরা বলত আল-থুরাই।

হিন্দুধর্মে এটি কার্তিক, যা যুদ্ধে দেবতা কার্তিকের সঙ্গে যুক্ত এবং সপ্তমাত্রিকাদের (সাত মাতা) সঙ্গে সম্পর্কিত। বাইবেলেও তিনবার উল্লেখ আছে, যেখানে হিব্রু নামে ‘কিমাহ’ বলা হয়েছে। প্লিয়াডিসের সবচেয়ে প্রাচীন চিত্র পাওয়া যায় প্রায় ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের নেব্রা স্কাই ডিস্কে এবং প্রাচীন ব্যাবিলনীয় নক্ষত্রপঞ্জিতে এটিকে মুলমুল বলা হয়। গ্রিক, রোমান, মিসরীয় ও ইসলামিক ঐতিহ্যেও প্লিয়াডিসের উল্লেখ আছে। গ্রিক পুরাণে এই সাতটি তারা হলো অ্যাটলাস ও প্লিওনি নামের দেবীর সাত কন্যা—মায়া, ইলেকট্রা, ট্যাজিজেটি, আলসিয়োন, সেলায়েনো, স্টেরোপি ও মেরোপি।
গ্রিক পুরাণের দৈত্য ওরায়ন ছিল শিকারি এবং তার চোখ ছিল অতি প্রখর, তার ইচ্ছা ছিল সাত বোনকে শিকার করার। জিউস তাদের রক্ষা করার জন্য আকাশে স্থানান্তর করেন। এর ফলে তারা নক্ষত্রগুচ্ছ হিসেবে চিরকাল উজ্জ্বলভাবে আকাশে দেখা যায়। প্রত্যেক বোনের একটি বিশেষ চরিত্র এবং দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে।
মায়া: জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, মায়া হলো সবচেয়ে বড় বোন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গর্ভজাত শক্তির প্রতীক।
ইলেকট্রা: বীরত্বের প্রতীক, যাকে শহুরে এবং সমুদ্রভ্রমণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
ট্যাজিজেটি: সাহস ও বিচক্ষণতার প্রতীক।
আলসিয়োন: শান্তি ও স্নিগ্ধতার প্রতীক, যা নক্ষত্রগুচ্ছের নীলাভ ঝলমলে আলোতে ফুটে ওঠে।
সেলায়েনো: রহস্য ও অজানা শক্তির প্রতীক।
স্টেরোপি: প্রেরণা ও দ্রুততা দেয়, নক্ষত্রগুচ্ছের আলোকে আরও উজ্জ্বল করে।
মেরোপি: একমাত্র বোন যে মানুষের সঙ্গে বিয়ে বা প্রেমের কাহিনিতে যুক্ত হয়েছে, তাই কখনো অন্যদের চেয়ে কম উজ্জ্বল দেখা যায়।
এই কাহিনি শুধু রোমাঞ্চকর নয়; এটি মানবকল্পনা, ঋতুচক্র, কৃষি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এই সাত তারাকে ঋতুর সূচক, নৌপথের নির্দেশক বা প্রেম ও গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও ধরা হয়েছে।
আজও প্লিয়াডিস নক্ষত্রগুচ্ছ খালি চোখে বা বাইনোকুলার দিয়ে দেখা যায়, বিশেষ করে ৩১ ডিসেম্বরের রাতে যখন প্রায় পূর্ণ চাঁদ তার পাশে ভেসে আসে। এই রাতের দৃশ্য শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বা পর্যবেক্ষকদের জন্য নয়, দর্শনার্থীদের জন্য দারুণ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

বছরের শেষ সূর্যাস্তের এক থেকে তিন ঘণ্টা পর, পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব আকাশে দেখা যাবে এই মহাজাগতিক সৌন্দর্য। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হচ্ছে, এটি খালি চোখেই দেখা সম্ভব; বাইনোকুলার থাকলে আরও পরিষ্কারভাবে দেখা যাবে। বাংলাদেশের সময় সন্ধ্যা ৬ থেকে রাত ১১টার মধ্যে আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে, তবে এই দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন আপনি।
এই রাতের দৃশ্য শুধু সৌন্দর্য নয়; বরং পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর দারুণ এক মুহূর্ত। ২০২৫ সালের শেষ রাতের এই মহাজাগতিক দৃশ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে এসেছে কল্পনা, বিশ্বাস ও বিজ্ঞানের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। চাঁদ যখন প্লিয়াডিসের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাবে, তখন প্রাচীন কাহিনি, নক্ষত্রগণিত এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য একসঙ্গে পুরোনো বছরকে জানাবে সুন্দরতম বিদায়। আর ২০২৬ আসবে নতুন আলোর বার্তা নিয়ে; স্বপ্ন, আশা ও নতুন সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে।
ছবি: উইকিপিডিয়া