মৃত্যু বা শোকের কি কোনো রং আছে? উত্তর হলো—আছে, তা হলো কালো। পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতির মানুষেরাও শোক প্রকাশে এই রংকে বেছে নিয়েছেন। এতে মিলেছে পৃথিবীর সব রং। তেমনি প্রশ্ন জাগে, শোকের কি কোনো ফুল আছে? সে–ও আছে, তবে বেশির ভাগ শোকের ফুলের রং হয় সাদা। তাই শোকের রং কালো অথচ শোকের নিমিত্তে নিবেদিত ফুলের রং অনেক ক্ষেত্রে সাদা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রথা অনুযায়ী সে দেশের বাসিন্দারা নির্দিষ্ট কয়েকটি ফুল বেছে নিয়েছেন শুধু পরলোকগত স্বজনদের জন্য।
অন্যভাবে বলা যায়, প্রাচীন জীবিতদের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ ও ভালোবাসা জানাবার জন্য ভবিষ্যতের মৃতরা বেছে নিয়েছে কিছু কিছু বিশেষ ফুল। আর সেগুলো শোকের স্মারক। তাই দেশ ভেদে উপহারের ফুল নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে। শোকের পুষ্পের মধ্যে শীর্ষে আছে চন্দ্রমল্লিকা, সাদা লিলি, গাঁদা, ওইয়ে, গ্লাইওয়ল, কার্নেশন, গোলাপ, অর্কিড ইত্যাদি। এবার বিভিন্ন দেশে শোক প্রকাশে প্রচলিত ফুলগুলোর কথা জেনে নেওয়া যাক।
ইউরোপ
ইউরোপের অনেক দেশেই ১ নভেম্বর মৃত আত্মীয়–পরিজনের জন্য স্মরণ করার একটি বিশেষ দিন। ইউরোপের ধর্মীয় ও জাতীয় জীবনে নভেম্বরের প্রথম দিনটি পরলোকগত স্বজনদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য, পরলোকগত আত্মজনের স্মরণ দিবস। প্রতিবছর ফ্রান্সসহ ইউরোপের প্রায় চৌদ্দটি দেশে এ দিবসটি ছুটির দিন। এই দিনে নগরের বেশির ভাগ মানুষই ফিরে যান তাদের শিকড়ের কাছে, যেখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন প্রিয়জনেরা। দেখা যাবে, এদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে দলে দলে মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছেন প্রিয়জনদের সমাধি বেদিতে ফুল সাজাবার জন্য। এই দিনে নগরের প্রাণচাঞ্চল্য থেমে যায়, চারদিকে অদ্ভুত এক শূন্যতা, সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা শান্ত একটি ভাব চারিদিকে। শেষ হেমন্তের রঙিন পাতা ঝরার এ দিনে প্রায়ই নীল আকাশ মুখ লুকায় ছাইরঙা মেঘের ঘন চাদরে, তির্যক বৃষ্টির আঘাতে পুরোনো পাতাগুলো ঝরে পড়তে শুরু করে। কেমন একটা বিষণ্ণতার সুর ধূসর প্রকৃতিতে। এ সময় নগর রং হারিয়ে বিবর্ণ হয়। শুধু শহর ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে সবুজ ঘাসের বৃষ্টিভেজা গালিচায় সারি সারি সমাধির মুক্ত অঙ্গন চন্দ্রমল্লিকার অপরূপ রূপের বর্ণিল বর্ণ ছটায় রঙিন হয়ে ওঠে। যেন পৃথিবীর সব রং এখানে এসে মিলেছে।
চারদিক আলো করে সমাধি বেদির শীতল পাথরে আছড়ে পড়ছে পুষ্পিত ভালোবাসার আকুতি। মৃত্যুর হিমশীতলতা ঢাকা পড়ে বাহারি চন্দ্রমল্লিকার উষ্ণ চাদরে। মনের অদৃশ্য বীণায় সুর তোলা শোকের বিষণ্ণতার মধ্যেও প্রয়াত প্রিয়জনদের মনে রাখার এক অপার্থিব আনন্দ। তৈরি হয় অপূর্ব ফুলের মিষ্টি সুবাসের এক নির্মল ও নিষ্কলুষ আবহ। চন্দ্রমল্লিকা বা ক্রিসেনথিমাম বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ফুল, গোলাপের পরেই এর স্থান। তারপরও এ অঞ্চলে এর ঠাঁই হয় না ঘরে, উপহার দেওয়া হয় না অন্য কাউকে। ইউরোপীয় মানসিকতায় চন্দ্রমল্লিকা সমাধির ফুল, শোকের স্মারক, পবিত্র পুষ্পাঞ্জলি। শুধু ইউরোপেই নয়, আরও অনেক দেশ আছে যেখানে নিদির্ষ্ট একটি বা একাধিক ফুল বেছে নেওয়া হয় মহাকালে বিলীন হয়ে যাওয়া পরলোকগত প্রিয়জনদের ভালোবাসা জানাবার জন্য, এ যেন চলে যাওয়া ভালোবাসার প্রতি বেদনার আর্তি নিয়ে ফিরে তাকানো।
মেক্সিকো, কলম্বিয়া ও গুয়েতেমালা
মেক্সিকো, কলম্বিয়া ও গুয়েতেমালা—এসব দেশের মানুষের বিশ্বাস যে মৃত স্বজনেরা মৃত্যুর পর অন্য এক জগতে জীবিত থাকেন। তাঁদের এই বিশ্বাসের কারণে প্রতিবছর ১ ও ২ নভেম্বর তাঁরা বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে মৃত স্বজনদের জন্য নানা আয়োজন করে থাকেন। সে আয়োজনে ফুলের ভূমিকা অন্যতম। বিশেষ করে হলুদ রঙের গাঁদা ফুল।
এই দিনে গাঁদা ফুলের মালা গেঁথে মৃতের ছবিতে টাঙানো হয়। সমাধিতে এই ফুল প্রাণের উত্তাপ ছড়ায়। এদেশে তাই এমন সুঘ্রাণের উজ্জ্বল হলুদ গাঁদা ফুল অর্থাৎ মেরিগোল্ড মৃত্যু ও শোকের প্রতীক। অথচ হিন্দুশাস্ত্রে বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা সিদ্ধিদাতা গণেশের প্রিয় রং হলো লাল আর প্রিয় ফুল লাল গাঁদা ফুল।
জাপান
ফুলপ্রিয় জাতি হিসেবে জাপানিদের খুবই সুনাম আছে। ফ্রান্সের মতো ইউরোপের অনেক দেশেই চন্দ্রমল্লিকা শোকের প্রতীক হলেও জাপানে জাতীয় ক্রিসেনথিমাম দিবস বা সুখের উৎসব হলো চন্দ্রমল্লিকার উৎসব। সেখানে প্রতিবছর ৯ সেপ্টেম্বর অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে এ উৎসব উদ্যাপন করা হয়। তার ওপর জাপানের সম্রাট তাঁর রাজকীয় সিলমোহরে এই ফুলের প্রতিকৃতি ব্যবহার করেন এবং সে দেশের পাসপোর্টের প্রচ্ছদেও অঙ্কিত থাকে এই ফুল। ফুলপ্রিয় জাপানিরা এ ফুলের নাম দিয়েছে ‘কিকু’। জাপানিদের কাছে চন্দ্রমল্লিকা সমৃদ্ধির প্রতীক। দেশ আর সংস্কৃতিভেদে শোক আর উৎসবে একই ফুল এই চন্দ্রমল্লিকা।
তবে এখানেও কথা আছে। উপহারের জন্য সাদা লিলি, ক্যামেলিয়া, প্রস্ফুটিত পদ্ম বা দুধসাদা রঙের যেকোনো ফুল উপহার দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এগুলো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মৃত আত্মার পবিত্রতা কামনা করে উৎসর্গ করা হয়। তা ছাড়া জাপানিরা টবসহ ফুলকে ততটা পছন্দ করে না। তবে টবসহ বনসাই উপহারে খুশি হন প্রায় প্রত্যেক জাপানি। জাপান, চীন ও কোরিয়ায় সাদা চন্দ্রমল্লিকা বেদনা ও শোকের প্রতীক।
কানাডা
ইউরোপের মতো কানাডাতেও চন্দ্রমল্লিকা ও সাদা লিলি মৃত্যুর স্মারক।
রাশিয়া
উজ্জ্বল সাদা রঙের আরুম লিলি কনের বিয়ের শ্বেত–শুভ্র ঝলমলে পোশাকের সঙ্গে অপরূপ রূপের জেল্লা ছড়াবে। তবে ভুলেও কখনো কোনো রাশিয়ান বন্ধুদের বিয়েতে এই ফুলের তোড়া উপহার দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এই ফুলের গঠন সেখানে মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। তা ছাড়া কুসংস্কার আছে, বিয়েতে আরুম লিলি উপহার দিলে সদ্য বিবাহিত দম্পতি খুব তাড়াতাড়ি বিবাহবিচ্ছেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন।
ব্রাজিল, চিলি ও আর্জেন্টিনা
উপহারের ফুল নির্বাচনে বেগুনি বা কালো রঙের ফুল অবশ্যই বাদ দিতে হবে। কারণ, এগুলো অন্তিমযাত্রার বিষণ্ন রং। কৌতূহলীদের জন্য এখানে খানিকটা বাড়তি তথ্য দেওয়া বাহুল্য হবে না। তা হলো, তুরস্কের হালফেটি গ্রামেই শুধু কালো গোলাপ পাওয়া যায়। তবে এ গোলাপ একদম কালো নয়, খানিকটা কালচে ধাঁচের। দুঃখের কথা, অত্যন্ত বিরল এ গোলাপ বিলুপ্তির পথে। পৃথিবীতে নীল ও বেগুনি ফুলের সংখ্যা অনেক কম।
যুক্তরাষ্ট্র
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত ব্যক্তির জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য উজ্জ্বল সাদা রঙের ফুল বেছে নেওয়া হয়। পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে হোয়াইট বা সাদা লিলি, পুনর্জন্ম ও পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। সাদা লিলির বিশেষ ঘ্রাণ জানিয়ে দেয় যে আশপাশে কেউ সদ্য লোকান্তরিত হয়েছেন আর সুবাসে ডুবে সৎকারের অপেক্ষায় আছেন মৃত ব্যক্তিটি। শোকের পুষ্পের তালিকায় এখানে বিশেষ স্থান দখল করে আছে আরেকটি খুবই সুন্দর ফুল, তা হলো সাদা গোলাপ। শেষযাত্রায় বা সমাধি বেদি সাজাতে সাদা লিলির মতোই সাদা গোলাপের তোড়া পছন্দ করেন এখানকার মানুষেরা। তাই সাধারণ উপহারের জন্য মনোগ্রাহী দুধসাদা—এই ফুল দুটি উপহার দেওয়ার ব্যাপারে অনেকটাই অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে মার্কিন মুলুকে।
ফুল আনন্দ, ভালোবাসা আর পবিত্রতার প্রতীক। ফুলহীন পৃথিবী কল্পনা করা যায় না। বাহারি রূপ ও রঙের সঙ্গে মিলিয়ে প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি এই ফুল। সেই সঙ্গে মিলেছে মিষ্টি ঘ্রাণ আর অমৃত অমিয়। আর তাই সভ্যতার সূচনাপর্ব থেকেই ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি লোকাচার বা লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ফুলের প্রতি ভালোবাসার সেই চিরন্তন আবেদন কমেনি এতটুকু। ভালোবাসার সব গল্পই সৃষ্টি হয়েছে ফুলকে ঘিরে, পুষ্পিত স্পন্দনে। তবে উপহারের ফুল নির্বাচনে যে সতর্ক হতে হয়, সে বোধ হয়েছে এভাবেই।
লেখক: ফ্রান্স প্রবাসী গবেষক
ছবি: লেখক ও পেকজেলস ডট কম