এই মুহূর্তে মিডিয়াপাড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হার্টথ্রব তাহসানের বিয়ে। তাঁর নববিবাহিত স্ত্রীর নাম রোজা আহমেদ। বাংলাদেশের জনপ্রিয় মেকআপ আর্টিস্টদের মধ্যে একজন তিনি। এত দিন তাঁর নাম শুধু বিউটি জগতে সুপরিচিত থাকলেও বিয়ের পর তিনি রীতিমতো তারকা বনে গেছেন। অভিনয়, গান, শিক্ষকতা সবকিছু মিলিয়ে তাহসান যতটা জনপ্রিয়, রোজাও তাঁর নিজের জগতে সমানভাবেই সুপরিচিত। তবে তাঁর এই পরিচিতি এক দিনে তৈরি হয়নি, এর জন্য ছোট থেকেই তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে বিউটি স্যালনের পাশাপাশি রোজা আহমেদ নিউইয়র্ক সিটিতেও খুলেছেন ‘রোজা’স ব্রাইডাল মেকওভার অ্যান্ড বিউটি কেয়ার স্যালন’। ২০২৪ সালের জুন মাসে তিনি তাঁর পেজে এই নিউজটি শেয়ার করে লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! এই মাত্র নিউইয়র্ক সিটিতে আমার “রোজা’স ব্রাইডাল মেকওভার অ্যান্ড বিউটি কেয়ার স্যালন”–এর ডেকোরেশন এবং সেটআপের কাজ শেষ হলো।’
পোস্টটি শেয়ার করতে গিয়ে তিনি বেশ ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন। সেটা তাঁর লেখায়ও ফুটে উঠেছিল। ছোটবেলায় বাবাকে হারানো রোজা এ সময় বারবার মনে করছিলেন তাঁর বাবার কথা। তিনি ওই পোস্টে একটি সেলফি শেয়ার করে লিখেছিলেন, ‘সেলফিটা একটু আগেই তুলেছি। সাধারণত আমার অনেক ছবি তোলা হয়, কিন্তু আজ এই সেলফিটা তোলার সময় চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অনেক সময় ধরে কাঁদলাম। কিন্তু কী মনে করে কাঁদছি বা কেন কাঁদছি, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি মা–বাবার প্রথম সন্তান, তাই সবচেয়ে আদরের ছিলাম সবার। আর বাবা আমাকে সব সময় বলত “আমার ছোট্ট পরিটা কইরে”।’
বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের অনেকেই অল্প বয়সে তাঁকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রোজা ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। স্কুলে পড়ার পাশাপাশি টিউশনি করে হাতখরচ চালিয়েছেন। পরিবারের বড়রা সেকথা জানার পর তাঁকে ছেড়ে দিতে হয় সেটাও। স্কুলে পড়ার সময় নাচের জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। নাচের সময় নিজেই সাজতেন, সেই সঙ্গে বান্ধবীদেরও সাজিয়ে দিতেন। অল্প বয়সেই বেশ প্রশংসা কুড়ান এ জন্য।
এরপর সুযোগ আসে এক কাজিনের বিয়েতে তাঁকে সাজিয়ে দেওয়ার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রোজাকে। বরিশালে জন্ম নেওয়া রোজা তখন ফ্রিল্যান্স মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। মাত্র ২০০০ টাকা পেমেন্টের বিনিময়ে কাজ শুরু করলেও তাঁর ছিল অগাধ আত্মবিশ্বাস। তার জোরেই ফ্রিল্যান্স বিউটি এক্সপার্ট হিসেবে একটা পরিচিতি তৈরি করতে সক্ষম হন। সেই সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের সাজিয়ে দিতেন রোজা। যদিও এ সময়েও পরিবার থেকে তিনি সমর্থন পাননি। কিন্তু চেষ্টা না থামিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা শুরু করার পরই সবাই বুঝতে পারে, রোজা সত্যিকার অর্থেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
রোজা ধীরে ধীরে ব্রাইডাল মেকআপের ট্রান্সফরমেশন ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা শুরু করেন। সেগুলো বেশ ভাইরাল হয়। কাজের প্রসার বাড়তে থাকে। বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়া–আসা করে ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করতেন রোজা। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ চালিয়ে যেতেও বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাঁকে। তবে তিনি নিজের যোগ্যতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
বসুন্ধরায় একটা ছোট্ট বাসায় স্টুডিও সেটআপ দিয়ে কাজ শুরু করলেও প্রথম বাসাটা ছেড়ে দিতে হয়। এরপর আবারও শুরু করেন বড় বাসা নিয়ে স্টুডিও সেটআপের কাজ। নিজে যে কষ্ট করেছেন সেটা যেন অন্যদের না করতে হয় সে জন্য এক বছরে ৫০০ মেয়েকে কাজ শিখিয়েছেন। এরপর ইমিগ্রেশন ভিসায় ইউএসএ যাওয়ার সুযোগ চলে আসে। সেখানে গিয়েও নিজের কাজের প্রচারণা শুরু করেন। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ক্লায়েন্ট পাওয়ার পর তাঁর উদ্যম আরও বেড়ে যায়। বাংলাদেশি ছাড়াও ভারতীয়, পাকিস্তানি ক্লায়েন্টও তাঁর কাছে নিয়মিত আসতেন। কসমেটোলজির ওপর পড়াশোনা করেছেন, নিয়েছেন লাইসেন্স। রোজা তাঁর স্যালনে রাখেন সবচেয়ে দামি ও মানসম্পন্ন প্রসাধনী।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রতিটি কথা খুব আবেগ নিয়ে লিখেছিলেন রোজা। নিজের মাকে সবার কাছে গর্বের সঙ্গে মেয়ের পরিচয় নিয়ে বলতে দেখে প্রতিবারই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। বাবার ভালোবাসা ছোট ভাই পায়নি বলে তাঁর জীবনে যেন কোনো কষ্ট ছুঁয়ে না যায় সেদিকেও রোজা খেয়াল রেখেছিলেন।
বাবার সেই ছোট্ট পরি জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে আজ সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন; দেশে ও বিদেশে কুড়িয়েছেন সুনাম। তাঁর কাজের জন্য সবাই তাঁকে এক নামেই চেনে। এই ছোট্ট মেয়েটাই সেদিনের সেই পোস্টে লিখেছিল, ‘আজ খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, বাবা, তোমার সেই ছোট্ট পরিটা অনেক বড় হয়েছে! আমার সব স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু তুমি বাবা।’
ফেসবুকের সেই পোস্টে রোজা সবার উদ্দেশে অনুরোধ করে বলেন, নিজেকে জীবনে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেন সব বাধা হাসিমুখে মোকাবিলা করার শক্তি নিজেই তৈরি করা যায়। সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ বড় হয়েছে। নিজেকে গড়ে তুলেছেন সফল মানুষ হিসেবে। এমনকি দেশের বহু নারীর মন হরণ করা তাহসানের ঘরনি হয়ে নিজের পরিচয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।
ছবি: রোজা আহমেদের ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল