ভাবুন তো, হুট করে এক দিনের জন্য আপনি ঢাকায় এসেছেন কোনো কাজে। রাতে থাকার জন্য খুঁজছেন কম খরচের কোনো জায়গা। কিন্তু ঢাকায় যেকোনো সাধারণ মানের হোটেলে থাকতে গেলেও গুনতে হয় অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এখন ভাবুন, এমন এক জায়গা, যেখানে আপনি থাকতে পারবেন দৈনিক মাত্র ১২০ টাকায়। তা–ও আবার বছরের পর বছর!
ঢাকার বুড়িগঙ্গার বুকে গড়ে উঠেছে এমন অনন্য রাতযাপনের ব্যবস্থা। যাকে বলা যায় ভাসমান বোর্ডিং। দিনের পরিশ্রম শেষে শহরের শ্রমজীবী মানুষ, হকার কিংবা দূর-দূরান্ত থেকে আগত যাত্রীরা আশ্রয় নেন এখানে, সামান্য টাকায়। মাত্র ১০০ থেকে ১২০ টাকায় পাওয়া যায় এক সিট বা দুই সিটের কেবিন, যেখানে আছে ফ্যান, আলো, বিশুদ্ধ পানি আর এক রাত নিশ্চিন্ত ঘুমের সুযোগ। এই বোর্ডিংগুলো যেন শহরের কোলাহল থেকে কিছুটা দূরে, অথচ জীবনযুদ্ধের খুব কাছাকাছি এক বাস্তব চিত্র। নৌকার কাঠ, লোহার পুরোনো গঠন, নদীর ঢেউ আর মানুষের বেঁচে থাকার আকুলতা—সব মিলিয়ে ভাসমান বোর্ডিং এখন ঢাকার ইতিহাসের এক নিঃশব্দ কিন্তু জীবন্ত অংশ।
রাজধানী ঘেঁষে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর স্থাপিত ব্যস্ততম বাবুবাজার সেতুর নিচেই অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মিটফোর্ড ঘাট, যা পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে অবস্থিত। ঘাটে পৌঁছাতেই চোখে পড়ে সারি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তিন-চারটি বড় ট্রলার। আশ্চর্যের বিষয়, এই ট্রলারগুলো আর নদীর বুকে চলে না; বহু বছর ধরে একই জায়গায় নোঙর ফেলে থিতু হয়ে আছে যেন সময়ের গায়ে জমে থাকা এক জীবন্ত ফসিল।
এগুলোই রূপান্তরিত হয়েছে রাতযাপনের বোর্ডিংয়ে। প্রতিটি ট্রলারের নির্দিষ্ট নাম আছে। শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিং, ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিং, বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং এবং উমা উজালা। চারটি বোর্ডিংয়ে আছে চল্লিশটি কেবিন। দৈনিক মাত্র ১২০ টাকায় থাকা যায় ছোট্ট একটি কামরায়, যা স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এক পরম আশ্রয়স্থল। কারও কারও জন্য এই ট্রলারগুলোই যেন চিরস্থায়ী আবাস। সারা দিনের পরিশ্রমের পরে শ্রমজীবী মানুষ ও যাত্রীরা এখানে নামমাত্র টাকায় বিশ্রাম নিতে পারেন।
একটা বোর্ডিংয়ের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই ভাসমান বোর্ডিংগুলোর ইতিহাস বেশ পুরোনো। পাকিস্তান আমল থেকেই এর যাত্রা শুরু। প্রতিদিন প্রায় সব কক্ষই ভরা থাকে। অতিথিদের আইডি কার্ড যাচাইয়ের পরই রুম ভাড়া দেওয়া হয়। সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১২০ টাকা, আর মাত্র ৩০ টাকা যোগ করলেই পাওয়া যায় ডাবল কেবিন।
এখানে শুধু থাকার ব্যবস্থা আছে। খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব অতিথির নিজের। কেউ চাইলে কেরোসিনের স্টোভে নিজের মতো রান্না করে নিতে পারেন। প্রতিটি রুমেই রয়েছে তোশক, কাঁথা, বালিশ ও প্রয়োজনীয় আসবাব। ম্যানেজারের ভাষায়, ‘ঢাকা শহরের মধ্যে এত কম টাকায় নিরাপদে থাকা যায় শুধু এখানেই।’
এই বোর্ডিংগুলোর প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকার সদরঘাটে। এরপর স্থানান্তরিত হয় ওয়াইজঘাটে। সেখান থেকে নবাববাড়ি হয়ে এখনকার অবস্থান মিটফোর্ড ঘাটে। দীর্ঘদিন ধরে এখানেই চলছে এই ভাসমান বোর্ডিংগুলোর কার্যক্রম।
বোর্ডিংয়ের মালিক ও বাসিন্দাদের মধ্যে সম্পর্কও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। নিম্ন আয়ের মানুষের সুবিধার কথা মাথায় রেখে অনেক সময় ভাড়া পরিশোধে উদারতা দেখান মালিকরা। কেউ চাইলে এক-দুই দিন পর একসঙ্গে ভাড়া দিতে পারেন।
এখানকার অনেক বাসিন্দাই আছেন, যাঁরা টানা ১০ থেকে ১২ বছর ধরে এই বোর্ডিংয়েই থাকছেন। তাঁদের মতে, ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে খরচ কম, স্বাধীনতা আছে। নিজের মতো থাকার সুযোগই এই বোর্ডিংগুলোকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
এই ভাসমান বোর্ডিংগুলো শুধু আশ্রয় নয়—এ যেন শহরের এক অজানা বাস্তবতা, যেখানে নদী, মানুষ আর সময়ের গল্প একসঙ্গে গলাগলি করে বেঁচে থাকে।
ছবি: হাল ফ্যাশন