সকালের নাশতার আগে না পরে দাঁত ব্রাশ করেন আপনি? কয়েক দশক ধরে দিনের শুরুতে ব্রেকফাস্টের পরেই দাঁত মাজার পরামর্শ দিয়ে আসছেন ডেন্টিস্টরা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক৷ ভুল সময়ে ব্রাশ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আপনার দাঁতের এনামেল। সেই সঙ্গে বাড়তে পারে সংবেদনশীলতাও। সাম্প্রতিক গবেষণা আর বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে তাই জেনে নিন দাঁতের সুরক্ষায় দাঁত ব্রাশের সঠিক সময় নিয়ে কী বলা হচ্ছে এখন।
আমরা প্রায় সবাই সকালে ঘুম থেকে উঠেই দাঁত ব্রাশ করে থাকি। কিন্তু এই কাজটি আপনি কখন করবেন? নাশতার আগে, না পরে? এই ছোট একটি প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে থাকতে পারে আপনার দাঁতের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতা। বিশ্বজুড়ে দন্ত চিকিৎসকেরা প্রতিদিন অন্তত দুইবার দাঁত ব্রাশ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। একবার সকালে এবং আরেকবার রাতে ঘুমানোর আগে। তবে বাস্তবে অনেকেই অলসতার কারণে রাতে দাঁত ব্রাশ করাটা এড়িয়ে যান, যা আমাদের দাঁতের জন্য বেশ ক্ষতিকর।
সময়ই মুখ্য বিষয়
খাবারের সময়ের সঙ্গে দাঁত ব্রাশ করার সময়টাও কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আপনি দাঁত ব্রাশ করছেন ঠিক কোন সময়ে, তা আপনার দাঁতের এনামেল রক্ষা, মুখের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং সামগ্রিকভাবে মুখগহ্বরের দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা রাখে। অনেকেই ভেবে থাকেন, যেকোনো সময় দাঁত ব্রাশ করলেই হলো। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। খাবারের আগে বা পরে দাঁত ব্রাশ করলে মুখের অভ্যন্তরে ঘটে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া।
ব্যাকটেরিয়া দূর হয়
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতার আগে দাঁত ব্রাশ করাটা অনেক দন্ত চিকিৎসকের মতে সবচেয়ে ভালো অভ্যাস। কেননা, এতে রাতে মুখের ভেতরে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়া দূর হয়। রাতে ঘুমানোর সময় মুখে ব্যাকটেরিয়া জমতে থাকে, যার ফলে প্লাক তৈরি হয় ও মুখ থেকে বাজে গন্ধ আসে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করলে এসব দূর হয়ে যায় এবং মুখও তখন ফ্রেশ লাগে।
দাঁত সুরক্ষা পায়
দাঁত ব্রাশ করার সময় আমাদের টুথপেস্টের ফ্লুরাইড দাঁতের ওপর একটি সুরক্ষার স্তর তৈরি করে। ফলে নাশতার মেনুতে যেসব খাবার অ্যাসিডিক (যেমন ফলের রস, টকদই), সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের দাঁত রক্ষা পায়।
এনামেল ক্ষয় হয় না
টক জাতীয় খাবার খাওয়ার পড়ে আমাদের দাঁতের ক্ষারীয় এনামেল কিছুটা সংবেদনশীল হয়ে যায়। এই সময় ব্রাশ করলে এনামেল ক্ষয় হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। তাই নাশতার আগে দাঁত ব্রাশ করলে সেই ক্ষয় অনেকটাই এড়ানো যায়।
অনেকেই মনে করেন, নাশতা করার পর দাঁত ব্রাশ করলেই দাঁতের সব খাবারের দাগ, কণা, আর দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায় এবং মুখ থাকে একদম পরিষ্কার। এটা সত্যি যে খাবারের পর দাঁত ব্রাশ করলে তাৎক্ষণিকভাবে মুখে এক ধরনের সতেজতা পাওয়া যায়। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, এতে কিছু ঝুঁকি থেকে যায়, বিশেষ করে যদি আপনি সঙ্গে সঙ্গে দাঁত ব্রাশ করেন। এগুলো সম্পর্কে চলুন জেনে নিই।
এনামেল ক্ষয়ের আশঙ্কা বাড়ে
যেমন কমলার রস, টকদই, আঙুর, টমেটো, কফি বা জুস জাতীয় খাবার অ্যাসিডিক খাবার খাওয়া ও পানীয় পান করার পরে মুখের ভেতরের পিএইচ মাত্রা কমে যায় এবং দাঁতের বাইরের শক্ত আবরণ এনামেল কিছুটা নরম হয়ে পড়ে। এমন সময় যদি আপনি শক্তি প্রয়োগ করে ঘষে ঘষে ও বেশিক্ষণ ধরে ব্রাশ করেন, তাহলে দাঁতের ওপরে থাকা এই নরম এনামেল ঘর্ষণের কারণে ক্ষয় হয়ে যেতে পারে। সময়ের সঙ্গে এই ক্ষয় দাঁতের স্থায়ী ক্ষতি, সংবেদনশীলতা ও দাঁত ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
কমপক্ষে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করা জরুরি
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নাশতার পর দাঁত ব্রাশ করতে চাইলে অন্তত ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এই সময়ের মধ্যে মুখের লালা (saliva) স্বাভাবিকভাবে মুখের অ্যাসিডকে নিরপেক্ষ (neutralize) করে এবং দাঁতের এনামেল পুনরায় শক্ত হয়ে ওঠে। তখন ব্রাশ করলে দাঁতের ক্ষতি হয় না। অনেকেই অফিস বা ক্লাসে যাওয়ার তাড়ায় খাওয়ার পর পরই সঙ্গে সঙ্গে দাঁত ব্রাশ করে ফেলেন। এই অভ্যাসটিই দিনের পর দিন দাঁতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই সময়ের দিকে একটু নজর দিন। আবার ঘুম থেকে উঠে বাসী মুখে নাশতা করা স্বাস্থ্যকর নয়। তাই এসময় আগে ব্রাশ করে নিয়েই নাশতা করা উচিত। সেক্ষেত্রে নাশতার পরে ভালোভাবে কুলকুচি করে নিলেই হবে। আর কেউ যদি একান্তই নাশতার পরে ব্রাশ করতে চান, তাহলে আগে ব্রাশ না করে কুলকুচি করুন। কারণ এত ঘন ঘন ব্রাশ করা দাঁতের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
নাশতার পরে কুলকুচি করুন
নাশতার পর সাধারণ পানি দিয়ে কুলকুচি (rinse) করুন। এতে আপনার মুখ থেকে খাবারের টুকরো, অতিরিক্ত অ্যাসিড,মিষ্টি বা দুধ জাতীয় উপাদানের অবশিষ্টাংশ এই সব কিছু ধুয়ে যাবে, ফলে মুখ পরিষ্কার থাকে এবং দাঁতের ক্ষয়ের ঝুঁকিও অনেকটা কমে যায়।
চিকিৎসকদের পরামর্শ কী বলে
প্রায় সব দন্ত চিকিৎসকই দিনে দুই বার দাঁত ব্রাশের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সকালে ও রাতে ঘুমানোর আগে। আর সকালের ব্রাশ নিয়ে এখন বলা হচ্ছে, নাশতার আগে ব্রাশ করাই ভালো। কারণ এটি শুধু দাঁতের এনামেলকেই রক্ষা করে না, বরং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিও রোধ করে।
মাউথওয়াশ ও ফ্লসের সঠিক ব্যবহার
অনেকে ভাবেন, শুধু মাউথওয়াশ ব্যবহার করলেই দাঁত পরিষ্কার থাকে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মাউথওয়াশ মুখকে সতেজ রাখে ঠিকই, কিন্তু দাঁতের ওপর জমে থাকা প্লাক বা খাবারের দাগ দূর করতে পারে না। এটা অনেকটা গোসল না করে শুধু পারফিউম লাগানোর মতো বিষয় হয়ে যায় যে সুগন্ধ থাকবে, কিন্তু ময়লা যাবে না।
দাঁতের যত্ন শুধুমাত্র পেস্ট আর ব্রাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সঙ্গে সময়, নিয়ম এবং সচেতনতাও জড়িত। সকালের নাশতার আগে বা পরে ব্রাশ করার অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে আপনার দাঁতের স্বাস্থ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সকালের পাশাপাশি রাতে ঘুমানোর আগে ব্রাশ করাও অপরিহার্য।
তথ্যসূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া
ছবি: পেকজেলস