হ্যালোউইন স্পেশাল: আধুনিক পপ সংস্কৃতির রহস্য অনুষঙ্গ লাবুবু ও পাজুজু
শেয়ার করুন
ফলো করুন

একটা ছোট্ট পুতুল। নাম তার লাবুবু। প্রশস্ত ঠোঁটের মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে ধারালো দাঁতের মতো হাসি, বড় চোখ আর মুখভর্তি অদ্ভুত এক দুষ্টুমি। ২০১৫ সালে হংকংয়ের চিত্রকর ও পপ মার্টের ডিজাইনার কাসিং লাং তাঁর বই ‘দ্য মনস্টার’–এর জন্য তৈরি করেছিলেন চরিত্রটি। তাঁর কল্পনায় লাবুবু ছিল এক রূপকথার পৃথিবীর দুষ্টু কিন্তু ভালো মনের পরি; ঠিক যেন শৈশবের কল্পনা থেকে উঠে আসা এক জাদুকরি চরিত্র।

কারো কাছে ভালো, কারো কাছে মন্দ
কারো কাছে ভালো, কারো কাছে মন্দ

লাবুবু পুতুল চরিত্রের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগটি করেন রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের দুই সদস্য, একাতেরিনা আলতাবায়েভা ও তাতিয়ানা বুতস্কায়া। তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছেন লাবুবু পুতুল নিষিদ্ধ করার জন্য। তাঁদের অভিযোগ, এই পুতুলের ‘ভয়ংকর চেহারা’ শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া রাশিয়ান ভাষায় কোনো সতর্কবার্তা বা নির্দেশনাও ছিল না পুতুলের প্যাকেজিংয়ে।

বিজ্ঞাপন

একই সময়ে, ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে কর্তৃপক্ষ চার হাজারের বেশি লাবুবু পুতুল জব্দ করে ঘোষণা দেয় যে এটি শিশুদের ‘আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে’ এবং ‘অশুভ আত্মাদের আকর্ষণ করে’।

রাশিয়া ও ইরাকে নিষিদ্ধ লাবুবু
রাশিয়া ও ইরাকে নিষিদ্ধ লাবুবু

এই আতঙ্কের সূত্রপাত হয় এক ভাইরাল ইনস্টাগ্রাম ভিডিও থেকে। এক ব্যবহারকারী বাদামি লাবুবু পুতুলের পাশে একটি প্রাচীন মেসোপটেমীয় ডেমন পাজুজুর ছবি জুড়ে দেন।

বিজ্ঞাপন

ভিডিওটির শিরোনাম ছিল, ‘অভিভাবকেরা সাবধান! এই ডেমনিক খেলনা কিনবেন না’! দশ সেকেন্ডের মধ্যেই দেখা যায় দ্য সিম্পসন–এর একটি দৃশ্য, যেখানে মার্জ ভুলবশত পাজুজুর মূর্তি কিনে নেয়। আর সেটা নিয়ে তার সন্তান খেলা করতে থাকে। সেই থেকেই জন্ম নেয় লাবুবু-পাজুজু ষড়যন্ত্র নামের একটি তত্ত্ব। এর মানে, পুতুলটির মধ্যে রয়েছে দানবীয় শক্তি। টিকটক, রেডিট, ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একই ভয়।

ভূতুড়ে থেলনা কেনা উচি] না
ভূতুড়ে থেলনা কেনা উচি] না

কেউ বলছে রাতে পুতুলটা নিজে থেকে নড়েছে, কেউ আবার বলছে, ঘরে অদ্ভুত শব্দ শুনেছে। অনেকে তো পুতুলটা ধ্বংস করেই ভিডিও বানিয়ে ফেলেছে, ‘ডেস্ট্রয়িং মাই পজেজড লাবুবু’ শিরোনামে। বিখ্যাত হরর মুভি ‘অ্যানাবেল’–এর কথা মনে করিয়ে দেয় যেন এই লাবুবু। আর এই পাজুজুর প্রচলিত মিথ হচ্ছে, পাজুজু প্রাচীন মেসোপটেমীয় পুরাণের এক ভয়ংকর দৈত্য দেবতা বা ডেমন রাজা। একে সাধারণত দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের বাতাস ও রোগের দেবতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

পাজুজুকে বলা হয় বাতাস ও দুর্ভিক্ষের অশুভ আত্মাদের রাজা। তার শরীর মানুষের, মুখ সিংহ বা কুকুরের মতো, মাথায় শিং, পিঠে ডানা আছে এবং পায়ের জায়গায় ঈগলের নখ। সে রোগ, প্লেগ ও খরার প্রতীক, বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ওপর ভর করে বলে বিশ্বাস করা হতো। তবে মজার বিষয় হলো, পাজুজু শুধুই অশুভ নয়, তাকে অনেক সময় আরও ভয়ংকর দুষ্ট আত্মা লামাশ্তু থেকে রক্ষা পাওয়ার কবজ হিসেবেও ডাকা হতো। অর্থাৎ মানুষ পাজুজুর ভয়েই তাকে পূজা করত, যেন সে ক্ষতি না করে, বরং রক্ষা করে।

পাজুজুকে বলা হয় বাতাস ও দুর্ভিক্ষের অশুভ আত্মাদের রাজা
পাজুজুকে বলা হয় বাতাস ও দুর্ভিক্ষের অশুভ আত্মাদের রাজা

এর মধ্যে পাকিস্তানের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মিশি খানও এতে যোগ দেন। তিনি বলেন, ‘এই পুতুলগুলো নেতিবাচক আধ্যাত্মিক শক্তি বা জিনদের আকর্ষণ করতে পারে। শিশুদের থেকে দূরে রাখুন।’

অবশ্য শিল্পী কাসিং লাংয়ের মতে, এসবই ভুল ব্যাখ্যা। লাবুবু তাঁর ‘আত্মার অংশ’ একজন দুষ্টু কিন্তু সহৃদয় এলফ, যাকে তিনি নেদারল্যান্ডসে পড়া ইউরোপীয় রূপকথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এঁকেছেন।

থারে থরে সাজানো লাবুবু সামনে স্রষ্টা কাসিং লাং
থারে থরে সাজানো লাবুবু সামনে স্রষ্টা কাসিং লাং

সব বিতর্কের মধ্যেই চীনা কোম্পানি পপ মার্টের ব্যবসা পৌঁছায় চূড়ান্ত উচ্চতায়। লাবুবু পুতুলের বিক্রির কারণে তাদের চেয়ারম্যান ওয়াং নিং ৩৮ বছর বয়সে হয়ে গেছেন চীনের তরুণতম বিলিয়নিয়ারদের একজন, যাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বখ্যাত সংগীত তারকা রিয়ানা, ব্ল্যাকপিঙ্কের লিসা থেকে শুরু করে ইউরোপের সেলিব্রিটিরাও পোস্ট করছেন লাবুবুর ছবি। অন্যদিকে রাশিয়া ও ইরাকে এটি নিষিদ্ধ। একদিকে বাজার, অন্যদিকে মিথ—এই দ্বন্দ্বই লাবুবুকে পরিণত করেছে এক আধুনিক পপ সংস্কৃতির রহস্যে।

পপ মার্টে লাবুবু বিক্রির ধুম
পপ মার্টে লাবুবু বিক্রির ধুম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নিছকই ‘ইন্টারনেটে জন্ম নেওয়া আতঙ্ক’; যেমন স্লেন্ডারম্যান বা মম চ্যালেঞ্জ একসময় ছড়িয়েছিল। যদিও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যে লাবুবুর সঙ্গে কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা যুক্ত, তবু মানুষের মন এমন কিছুতে বিশ্বাস করতে চায় যা যুক্তির বাইরে, যা অন্ধকারে আলো ফেলে এক অদ্ভুত মোহের মতো।

লাবুবু হয়তো শুধুই একটি পুতুল, শিল্পীর কল্পনার চরিত্র। কিন্তু ২০২৫ সালের এই ডিজিটাল পৃথিবীতে, যেখানে ভয় ভাইরাল হয় আর মিথ বিক্রি হয়, সেখানে কে বলতে পারে, কোনটা বাস্তব আর কোনটা কল্পনা?

আজ রাতে েউ আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতেই পারে
আজ রাতে েউ আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতেই পারে

আপনি হয়তো এই লেখা পড়ছেন। পড়া শেষ হলে পেছনে তাকিয়ে দেখুন তো, হয়তো কোথাও কোনো তাকের ওপর, একটা ছোট্ট পুতুল দাঁড়িয়ে আছে; দাঁতের ফাঁকে মৃদু হাসছে আর রিনরিনে কণ্ঠে আপনাকে জানাচ্ছে হ্যালোউইনের শুভেচ্ছা।

ছবি: ইন্সটাগ্রাম ও উইকিপিডিয়া

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ০০
বিজ্ঞাপন