বিকেলবেলা তড়িঘড়ি করে কার্পেন্ট্রি ওয়ার্কশপের দিকে ছুটছিলাম কাঠের খোঁজে। পাঁচটা বাজলেই ওয়ার্কশপ বন্ধ। এমন তাড়াহুড়োয় খুব সহজে হাঁটার গতি কমার কথা না। কিন্তু ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিছু দূর এগোতেই পাশের বাগানটায় চোখ আঁটকে গেল। সবুজ ঘাসের ওপর চকচকে কমলা রঙের কী যেন লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রথম দেখায় চিনতে পারিনি, কিংবা এমন কোলাহলে দেখা হয়ে যাওয়ায় বিশ্বাস করতে পারিনি হয়তো। কমলা দামা; বাংলাদেশে দামা প্রজাতির সবচেয়ে পরিচিত পাখি।
বুয়েটের ছোট্ট সবুজ ক্যাম্পাসে কমলা দামার দেখা পাওয়া অবাক হওয়ার মতো কিছু না। তবে এত মানুষের যাতায়াতের পথে এমন লাজুক স্বভাবের পাখির দেখা পাওয়া অদ্ভুত বটে। ঘাসের ওপর লাফালাফি করে পোকামাকড় খেতে খেতে কখন রাস্তার ধারে চলে এসেছে খেয়াল করেনি হয়তো। তাতে অবশ্য আমাদের ভালোই। সঙ্গে ক্যামেরা না থাকায় ভালো ছবি না পেলেও দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম বেশ খানিকক্ষণ। ফোনে ছবি তুলার আশায় একটু এগোতেই অল্প দূরে কামরাঙা গাছ থেকে সঙ্গী পাখিটিও নেমে এল। হাতে সময় থাকলে হয়তো আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতাম, কিন্তু বিধি বাম। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে পাঁচটা ছুঁই। দামা দম্পতিকে রেখেই ছুট দিলাম নিজের কাজে।
উজ্জ্বল কমলা রঙের অদ্ভুত সুন্দর কমলা দামা বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে পরিচিত বিভিন্ন নামে। কেউ ডাকে কমলা বউ, কেউ মেটে দোয়েল, কেউবা কমলাফুলি। ইংরেজিতে Orange-headed Thrush, বৈজ্ঞানিক নাম Geokichla citrina. প্রায় দোয়েল আকৃতির পাখিটি খাদ্য সংগ্রহ করে মূলত মাটি থেকেই। পোকামাকড়, কেঁচো এসবই প্রধান খাদ্য। গ্রাম এলাকায় মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খাবার খেতে খেতে মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ে গেরস্ত বাড়ির উঠানে। খুব নিরীহ পাখিটির শত্রুর হাত থেকে ডিম বা ছানাদের রক্ষা করার প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলতে তীক্ষ্ণ ধাতব কণ্ঠের হুইসেল ছাড়া কিছু নেই বললেই চলে। তাই স্বাভাবিকভাবেই যতটা সম্ভব নিভৃতে থাকতে পছন্দ করে।
গ্রীষ্ম থেকে শরৎ- তিন মাস শিকড়, লতাপাতা, ঘাস দিয়ে শক্তপোক্ত শৈল্পিক বাড়ি বানায় উঁচু ঝোপ বা সুপারি গাছের পাতায়। কেবল দেখার সৌন্দর্যই নয়, গায়ক পাখি হিসেবেও কমলা বউ এর বেশ খ্যাতি আছে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে এদের মিষ্টি গান শোনার সৌভাগ্য যে কারও হতে পারে। বলাই বাহুল্য, পাখিটির নাম এসেছে তার গায়ের উজ্জ্বল কমলা রং থেকে। মাথা, ঘাড়, গলা, চিবুক, পেট- সবটাই কমলা। গলায় খানিকটা আর লেজের তলদেশ সাদা। পিঠ থেকে লেজের উপরিভাগ ধূসর, ঠোঁট কালচে। ঘাড়ের কাছে ডানার প্রান্তে গোল গোল সাদা ফোঁটা। পা জোড়া গোলাপি রঙের। ফেব্রুয়ারি থেকে জুনে মেয়ে পাখি গোলাপি-মাখনরঙা ডিম পাড়ে একসঙ্গে ৪টি। ডিম ফুটে ছানা হতে সময় লাগে ১৪ দিন।
সাধারণত ঝোপঝাড় আর গ্রামীণ পরিবেশ পছন্দ করলেও শহরাঞ্চলে কমলা দামার দেখা মিলে মাঝেমধ্যে। বুয়েট ক্যাম্পাসেই দ্বিতীয়বার দেখা পাওয়ার আগে পাখিটির দেখা পেয়েছিলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তবে শহরাঞ্চলে গাছের সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে কমছে এই গায়ক পাখির সংখ্যাও। আবার পোকামাকড় নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশকের ব্যবহার খাদ্যের পরিমাণও কমিয়ে দিচ্ছে। গত কয়েক দশকে শুধু হংকংয়ে কমলা দামার সংখ্যা বৃদ্ধির হার লক্ষ্য করলেই দেখা যায় বনায়নের মাধ্যমে সুন্দর এই পাখিটিকে শহরাঞ্চলে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
ছবি: মো. আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ