বসন্ত আসার আগেই মন–রাঙানো পলাশ প্রকৃতিতে আগাম বসন্তের আগমনী শুরু করেছে। তার আভাস এখনই দিয়েছে প্রকৃতি। তা না হলে ফাল্গুন–চৈত্রের পলাশ এত আগেই চোখ মেলবে কেন? বাতাসের মৃদুমন্দ তালে উঁচু গাছের শাখায় পলাশ দেখে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী পথিক সুন্দর স্বপ্নে মগ্ন হতেই পারে। ফাল্গুন ও চৈত্র—এ দুই মাস নিয়ে বসন্তকাল। এ ছাড়া আগুনরঙা পলাশ ফুল, পলাশের রং ছড়িয়ে ঋতুপরিক্রমায় এসে গেছে বসন্তকাল। পলাশের ডালে ডালে পাখিদের বিচরণ জানান দেয় প্রকৃতির সেই পরিবর্তনের বার্তা।
চারদিকে ফুলের সুবাস ও কোকিলের কুহু কুহু ডাকই বলে দেয় বসন্ত এসে গেছে। প্রকৃতিকে রাঙিয়ে গাছে গাছে ফোটা পলাশ ফুলে বসে সবুজ টিয়া।
ঋতুগুলো বাঁধন ছিঁড়ে অধিকার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাল দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন; কে কত আগে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। যদিও মাঘ মাস পলাশের প্রস্ফুটনের সময়, ফাগুনের হাওয়া তা আরও দ্রুত করেছে।
বসন্ত মানেই ফুলের সমারোহ আর ফুল মানেই রঙের মেলা। এই তো প্রকৃতি এখন পেয়েছে বসন্তের ছোঁয়া। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সবাই সাদরে বরণ করেছে ঋতুরাজ বসন্তকে। এই সময় পলাশ ফুলের সৌন্দর্য দূর থেকেই আগুনের মতো জ্বলতে দেখা যায়। বসন্তের মাতাল সমীরণে লালাভ বর্ণচ্ছটায় মন–রাঙানো পলাশ নিসর্গের আরেক রূপ তুলে ধরে। টকটকে লাল ছাড়াও হলুদ, লালচে ও কমলা রঙের পলাশও দেখা যায়। পয়লা ফাল্গুন বসন্তের ডাক দেয়। নানা রঙের ফুল ফোটে। কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশের রঙে ভরে ওঠে চারদিক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতা ও গানেও পলাশ ফুলের উল্লেখ আছে। যেমন দোলের গান ‘ওরে গৃহবাসী’–তে ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি, অশোকে পলাশে’ বা ‘ফাগুন হাওয়ায় হওয়ায়’ গানে ‘তোমার অশোকে কিংশুকে, অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে।’ এ যেন বসন্তে পলাশের রাজত্ব।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত। কিন্তু বসন্ত আসবে আর ফুল ফুটবে না, তা কী করে হয়! বসন্ত সঙ্গে নিয়ে এসেছে ফুল আর ফুল, প্রকৃতিকে ভরিয়ে তুলতে নানা ফুলের ডালা সঙ্গে নিয়েই বসন্ত এসে গেছে!
পলাশের নেশা তীব্র, পলাশ ফুল সবার মনে একবার হলেও দোলা দিয়েছে। তার ফুলের প্রেমের জালে জড়ায়নি—হয়তো এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বসন্তে পলাশবনে ঘোর লাগে। তবে বড় ক্ষণস্থায়ী পলাশের মৌসুম। মাত্র ২০ থেকে ২৫ দিন। তার নেশা লাগতে লাগতে, চিনে নিতে নিতে সে উধাও হয়ে যায়। যৌবনের উন্মাদনার মতো ক্ষণস্থায়ী। তবে এই ক্ষণস্থায়ী সুখ চলে গেলেও স্মৃতি থেকে যায় পুরো বছর। সেই স্মৃতি নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি আরেক বসন্তের।
কবিরা পলাশের বর্ণনা নানানভাবে দিয়েছেন, কেউ কবিতায়, কেউবা গানে গানে। রবীন্দ্রনাথ গানে লিখেছেন—
‘কুঞ্জবনের অঞ্জলি যে ছড়িয়ে পড়ে,
পলাশ কানন ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে।’
বাংলার গ্রামে ও শহরে প্রায় সব জায়গায় কমবেশি পলাশ ফুল দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামে পলাশগাছের নিচে শিশুরা ফুল দিয়ে খেলা করে। শিশুরা একে অপরের কানে ফুল দিয়ে দেয়। গ্রামবাংলার এই দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। তিন প্রকার রঙের পলাশের মধ্যে হলুদ পলাশের জন্ম ভারতবর্ষে। গাছটি খুব কষ্ট সইতে পারে। রুক্ষ ও শুষ্ক মাটিতেও পলাশ বিনা যত্নে ফুল দেয়।
বসন্তের আগমনকে ঘিরে কবিরাও লেখেন নানা গান ও কবিতা। শীতের জীর্ণতাকে সরিয়ে দিয়ে বসন্ত নিয়ে আসে মিষ্টি রোদ ও গাছে গাছে নতুন পাতা আর ফুল। চারদিকে একটা স্নিগ্ধ আবেশ তৈরি হয় এই বসন্তেই।
‘বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিল নেশা,
কারা যে ডাকিল পিছে,
বসন্ত এসে গেছে।’
এই গানের লাইনগুলো পছন্দ করে না—এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। গানের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুরাজ বসন্তও সবার পছন্দ করে। বাঙালি জীবনের সংস্কৃতির আবাহনে পলাশ ফুলের লালচে কমলা আভা হৃদয় সাজিয়ে দেয়। লালচে কমলা বর্ণচ্ছটার আবেগের ফুলগুলো ছন্দায়িত করে তোলে। আকাশে রক্তিম আলো ছড়িয়েই যেন কথা বলে পলাশ। বাংলার এই মাটিতে পলাশের আগমন বহুকাল আগে।
ছবি: কমল দাশ