৮০০ বছর ধরে শুক্লাম্বর দিঘির পাড়ে বসছে বিশ্বাসের মেলা
শেয়ার করুন
ফলো করুন


চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বরমা বাইনজুরীতে অবস্থিত শুক্লাম্বর দিঘির পাড়ে পৌষসংক্রান্তিতে পুণ্যস্নান ও মেলায় নামে লাখো মানুষের ঢল। আত্মশুদ্ধি, পাপমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণে প্রাচীন এই মেলায় দূরদূরান্ত থেকে আসেন পুণ্যার্থীরা। এমনকি পাশের দেশ ভারত, নেপাল থেকেও জড়ো হন বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের ভাষ্যমতে, বিশ্বাস করে দিঘির কাছে কিছু চাইলে তা পাওয়া যায়। মানত পূরণ করতে সংক্রান্তির শুভদিনে বিশ্বাসীদের সমাগম ঘটে দিঘির পাড়ে। লোকমুখে মেলাটির নাম ‘বিশ্বাসের মেলা’। সেই থেকেই মেলার নাম বিশ্বাসের মেলা।

মেলা প্রাঙ্গন
মেলা প্রাঙ্গন

সকাল থেকেই মেলা প্রাঙ্গণ মানুষের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক পরম্পরায় জানা যায়, আত্মশুদ্ধি, পাপমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণের জন্য দূরদূরান্ত থেকে আসা পুণ্যার্থীদের অনেকে অশ্বত্থগাছের নিচে কবুতর উড়িয়ে দেন। কেউ গাছের ডালে সুতা বেঁধে, কেউ–বা তীব্র শীত উপেক্ষা করে শুক্লাম্বর দিঘির জলে স্নান করে মনোবাসনা পূরণের প্রার্থনা করেন। অনেকে বিশাল দিঘির জলে ঢালেন তরল দুধ। রাঙামাটি থেকে আসা তরুণী গৃহবধূ দিঘিতে ডুব দিয়ে উঠে কলাপাতার ওপর বিভিন্ন ফল আর চাল নিয়ে ভাসিয়ে দেন জলে। বিয়ের তিন বছর পরও সন্তানের মুখ দেখেননি তিনি।

বিজ্ঞাপন

সন্তানের জন্য মানত করে দিঘিতে দুধ ঢেলে দেওয়ার কথা জানান বধূটি। মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য অশ্বত্থগাছের ডালে সুতা বাঁধছিলেন নানা জায়গা থেকে আসা ভক্তরা। মেলাটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান হলেও মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদেরও সমাবেশ ঘটে। এবারও মেলায় ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন কিছু মানুষ। কেবল বিশ্বাসের ভিত্তিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই সেই দিঘিতে যান, এমন নয়। উৎসব আর মেলায় আসেন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধসহ সব ধর্মের মানুষ। মেলা কমিটির সভাপতি মুসলমান। প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তিলধারণের ঠাঁই নেই। সনাতনীদের এই ধর্মীয় উৎসব যেন কোনো সামাজিক উৎসব।

দিঘীর জলে দুধ ঢালছেন পূণ্যার্থী
দিঘীর জলে দুধ ঢালছেন পূণ্যার্থী

জোড়া কবুতর হাতে শুক্লাম্বর দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটি পরিবার। তারা পূর্বে এসে মানত করেছিল। কুমিল্লা থেকে এসেছে তারা। বাবা বললেন, ‘আমার ছেলে বাসু চৌধুরী খুব অসুস্থ ছিল অনেক দিন। কিছুতেই রোগ সারছিল না। ছেলের আরোগ্যলাভের জন্য কবুতর মানত করেছিলেন তার মা। ছেলে এখন সুস্থ। তাই সপরিবার মানত পূরণ করতে এসেছি।’

পরিবারের শান্তি লাভের আশায়, ছেলে বা মেয়ের বিয়ের মনোবাসনা পূরণে মন্দির প্রাঙ্গণে অশ্বত্থগাছের ডালে সুতা বেঁধে দিয়ে যাচ্ছেন কারও মা, কারও বাবা। তাঁরা জানান, অনেকের কাছেই এই মেলার মাহাত্ম্য শুনেছেন আগে, এবার সরাসরি মেলায় অংশ নিতে পেরে খুশি তাঁরা।

বিজ্ঞাপন

দিঘিটি কেন ভক্তি-বিশ্বাসের প্রতীক?

১৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার সকালে শুক্লাম্বর দিঘির পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, পুণ্যার্থীরা কেউ দিঘিতে স্নান করছেন, কেউ দুধ ঢালছেন, কেউ কবুতর ও ছাগল স্নান করিয়ে পাশের লালসালু বাঁধা অশ্বত্থগাছের সামনে ছেড়ে দিচ্ছেন। গাছের সামনে বসে প্রার্থনাও করতে দেখা যায় অনেককে। দিঘির পাড়েই রয়েছে একটি মন্দির। মন্দির কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য অমর কান্তি ভট্টাচার্য জানান শুক্লাম্বর দিঘির গল্প।

পুজা হচ্ছে
পুজা হচ্ছে

চন্দনাইশ উপজেলার বরমা বাইনজুরী এলাকার শ্রীশ্রী শুক্লাম্বর পীঠ মন্দিরটি সনাতনী সম্প্রদায়ের প্রাচীন তীর্থস্থান। কথিত আছে, প্রায় ৮০০ বছর আগে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য নামের এক সাধক ভারতের নদীয়া থেকে শঙ্খ নদে জলপথে চন্দনাইশের বাইনজুরী গ্রামে আসেন। জানা গেছে, ভারতের নদীয়া এলাকায় শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্যের জন্ম। ৪০ বছর বয়সে সনাতন ধর্ম প্রচারের জন্য ভারত থেকে চন্দনাইশের বরমায় আসেন তিনি। শঙ্খের প্রবাহমূলে একটি অশ্বত্থের চারা রোপণ করে সেখানে শক্তির আরাধনা শুরু করেন। কঠোর আরাধনায় তিনি ত্রিপুরা দেবীর কৃপা লাভ করে সেই অশ্বত্থমূলেই সিদ্ধি লাভ করেন। বরমায় বেশ কিছু জমি কিনে শিবমন্দির তৈরির মাধ্যমে ধর্মপ্রচার ও জনসেবা শুরু করেন। তিনি নিজেই সেখানে খনন করেন দিঘি, কালক্রমে যা শুক্লাম্বর দিঘি নামে পরিচিতি পেয়েছে। শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্যের নাম অনুসারে এ মন্দিরের নামকরণ করা হয়।

মেলায় আসা এক শতবর্ষী বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনিও একসময় শৈশবে মা–বাবার সঙ্গে এই মেলায় ঘুরতে এসেছেন। ৭০ বছর ধরে আসছেন এই মেলায়। তিনি জানান, পূর্বপুরুষের মুখে শোনা, নদী দিয়ে একটি মরা গরু ভেসে এলে সাধকের অলৌকিক শক্তিতে গরুটি জীবিত হয়ে যায়। প্রায় ৫০ বছর সাধনাজীবন শেষে সেই সাধক দিঘির পাড় থেকে অলৌকিকভাবে লুপ্ত হয়ে যান। সাধনাকালে এ অঞ্চলের অনেকেই বিভিন্ন আধ্যাত্মিক শক্তি দেখে তাঁর ভক্ত হন। দিঘিটি ঘিরে তাঁর অনেক অলৌকিক কাহিনি শোনা যায়। যেমন দিঘির জল কখনো শুকায় না। কেউ এ দিঘি পারাপার করতে পারে না। দিঘিটিকে ঘিরে এমনও বিশ্বাস আছে যে মানত করে গাভির দুধ দিঘিতে ঢাললে সেই গাভি দুধ বেশি দেয়। এ কারণে সংক্রান্তির দিন খামারি ও গোয়ালাদের ভালো সমাগম দেখা যায় দিঘির পাড়ে। তবে দুধ নাকি দিঘির জলে মেশে না। নিচের দিকে চলে যায়। ভক্তদের মাধ্যমেই দিঘিটি নিয়ে অলৌকিক ধারণা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। উত্তরায়ণসংক্রান্তিতে এ দিঘিতে স্নান করলে গঙ্গাস্নানের ফললাভ হয়। তাই সংক্রান্তির দিন দিঘির পাড়ে মানুষ জড়ো হতে থাকে মনোবাসনা পূরণের জন্য।

মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, মেলায় নাগরদোলা, বিভিন্ন ধরনের বেতের তৈরি টুকরি, বড় ঝুড়ি, চালুনি, কুলা, মোড়া, দা-বটি-ছোরা, জাঁতা, মাটির ঘটি-বাটি, শীতের সবজি, মানকচু, শাপলা মাছ, ইলিশ মাছ, পুকুরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, চটপটি, বিনি ধানের খই, যব ধানের খই, বাতাসা, বাদামের টফি, নিমকি বিস্কুট, নকুলদানা, কদমা, গজা, নারকেলের চিড়াসহ বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। রয়েছে বিভিন্ন খাবার ও প্রসাধনীর দোকানও।

দিঘির পশ্চিম পাড়ে বিশাল জমিতে মেলার পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। সেখানে গিয়ে কথা হয় কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার টইটং এলাকার করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৫ বছর ধরে মেলায় দোকান দেন তিনি। যব ধানের খই, গইশ্যার তিল, ছোলা, নাড়ুসহ আরও অনেক খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসেন। এখানে ভালো পরিবেশে বিক্রি হয়।

পশ্চিম পটিয়ার কাশিয়াই গ্রামের দেবু বর্ধন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, এ মেলা তাঁদের জন্য একটি ঐতিহ্য। তাঁর বাবা গণেশ বর্ধনের সঙ্গে ৩২ বছর ধরে মেলায় বেচাবিক্রির জন্য আসছেন তিনি। এর আগে তাঁর দাদা আসতেন। বেচাবিক্রি খুব ভালো হয়। পরিবেশও ভালো। তবে মেলার দিন রাত ৯টার পর চলে যেতে হয়। তাই মেলাটি দুই দিন হলে ভালো হতো।

শুধু বিশ্বাস কিংবা সংক্রান্তির উৎসব নয়; শুক্লাম্বর দিঘির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও। স্থানীয় লোকজন জানান, ১৯৭১ সালে বাইনজুরী গ্রামের অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঘরহারা অনেক মানুষ তখন আশ্রয় নেন দিঘির পাড়ে এবং অশ্বত্থের তলায়।

এই উৎসব হিন্দুধর্মের হলেও এটা ধর্মের আবরণে সীমাবদ্ধ নেই। এটা সব ধর্মের মানুষের অসাম্প্রদায়িক একটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই জনপদ মোহন সেন, যতীন্দ্র মোহন সেন আর মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীদের জনপদ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোনো ঠাঁই নেই। সে জন্য পৌষসংক্রান্তির এই মেলা সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

ছবি: কমল দাশ

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন