মদনা টিয়া চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে শুনতে আর কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে বেশ কিছু ছবি তুললাম। এরপর সারা দিন বনের যেখানেই গিয়েছি, এদের উপস্থিতি চোখে পড়েছে। সেই সঙ্গে শুনেছি এদের নানা ধরনের কর্কশ ডাক। বাংলাদেশের আর কোনো টিয়া এত ধরনের ডাক ডাকতে পারে কি না, তা আমার জানা নেই।
বনের ডান পাশের পাতার ট্রেইল ধরে কাঠ ময়ূর খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে গোল ঘরের পাশের টিলার ওপর যেই না দাঁড়িয়েছি, তখনই দেখি একটি মেয়ে মদনা টিয়া সেগুনগাছের ডালে বসে আছে। মস্ত সেই সেগুনগাছে একটি কোটর দেখতে পেলাম। পাশেই দেখলাম দুটি পুরুষ মদনা টিয়া মারামারিতে লিপ্ত। বুঝতে দেরি হলো না যে এদের মারামারিটা মূলত ওই কোটর দখলে নেওয়ার যুদ্ধ— টেরিটোরিয়াল ফাইট। কিছুক্ষণ মারামারি করে একটি পুরুষ টিয়া রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেল। আর তখন আমরাও টিলা থেকে নেমে এলাম।
মদনা টিয়ার সঙ্গে আগে আমার দেখা হয়ে থাকলেও প্রথম ছবি তোলার সুযোগ পাই হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। সেখানে মান্দারগাছে এর ভালো কিছু ছবি তুলতে পেরেছি। এ ছাড়া একটি বড় গাছে এক জোড়া মদনা টিয়ার মেটিং রিচুয়াল পালন করার সময়ও ছবি তুলতে পেরেছি। তবে সেবার এদের ছবি তুলে মন ভরাতে না পারলেও এবার হাজারিখিলে সে সুযোগ পেয়ে এদের ছবি দিয়ে মেমোরি কার্ড ভর্তি করতে ভুল করিনি।
দেখতে অনিন্দ্যসুন্দর এই পাখির বাংলা নাম লালবুক টিয়া বা মদনা টিয়া। ইংরেজিতে বলে Red-breasted Parakeet, যার বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula alexandri. আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি দেখা সবুজ টিয়া। তারপরেই সহজলভ্যতার দিক দিয়ে মদনা টিয়ার অবস্থান। দেশের প্রায় সব বনেই এদের দেখা যায়। বন ছাড়াও লোকালয়েও এদেরকে মাঝেমধ্যে দেখা যায়।
অন্যান্য টিয়ার প্রজাতির মতোই মদনা টিয়া দেখতে ভারি সুন্দর। তবে এর গায়ে রঙের ছটা সম্ভবত অন্য প্রজাতির টিয়ার থেকে বেশি। পুরুষ আর মেয়ে টিয়ার রঙের কিছুটা পার্থক্য থাকে৷ এদের মাথা ধূসর, পাখার দুই পাশ গাঢ় সবুজ, পাখার মাঝখানে হলুদাভ সবুজ, বুক লালচে, লেজ নীল। এদের এক চোখ থেকে আরেক চোখ পর্যন্ত ঠোঁটের ওপর দিয়ে চিকন কালো একটি দাগ রয়েছে। যার কারণে ইংরেজিতে এদের আরেকটি নাম হলো Moustached Parakeet। গলার নিচে দুই দিকে কালো এবং পা কালো। পুরুষ আর মেয়ে টিয়ার যে পার্থক্যটা বেশি দৃশ্যমান, তা হলো এদের ঠোঁটের রং। পুরুষের ওপরের ঠোঁট লাল এবং নিচের ঠোঁট ধূসর-কালচে, আর মেয়ে মদনা টিয়ার দুটি ঠোঁট কালো।
এরা সচরাচর ঝাঁক বেঁধে চলে। এদের খাবারের তালিকায় আছে শস্য বীজ, ফল, ফুলের মধু, ফুলের কুড়ি। এদের দৈর্ঘ্য ৩৩ থেকে ৩৮ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এদের প্রজনন সময়। এ সময় এরা গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। স্ত্রী পাখি ২-৪টি ডিম দেয়। ২০-২৪ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। ৫২ দিনের মতো সময় লাগে এদের ওড়া শিখতে।
এদের সঙ্গে মানুষের এক জায়গায় সংঘাত দেখা দেয়। এরা শস্যজাতীয় ফসল খেতে খুব পছন্দ করে এবং শস্যবীজ খাওয়ার পাশাপাশি এরা অনেক ফসল নষ্ট করে। বিশেষ করে ধান পাকার মৌসুমে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে পাহাড়সংলগ্ন ধানখেতে মেনে আসে। ফলে কৃষকেরাও নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে এদেরকে তাড়ানোর জন্য। অনেক সময় এদেরকে ফাঁদ পেতে ধরা হয় বা নানাভাবে মেরেও ফেলা হয়। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের যারা বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করেন তাদের উচিত এটা নিয়ে গবেষণা করা যে কীভাবে মানুষ আর মদনা টিয়ার সংঘাত কমিয়ে আনা যায়। তাহলেই মানুষ আর এদের সুন্দর সহাবস্থান সম্ভব।
লেখক: ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার