কেরানীগঞ্জ মোগল, সুলতান ও নবাবদের ইতিহাসে সমৃদ্ধ এক জনপদ। কেরানীগঞ্জ নামকরণের পেছনে আছে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা। জনশ্রুতি আছে, নবাব শায়েস্তা খানের শাসনামলে নবাবের পাইক-পেয়াদা ও কেরানিরা বুড়িগঙ্গার ওপারে থাকতেন। ধারণা করা হয়, এই কেরানিদের নামানুসারে কেরানীগঞ্জের নামকরণ করা হয়। আরেকটি মতানুসারে, মোগল আমলে ঢাকার তৃতীয় গভর্নর ইব্রাহীম খাঁনের দুজন কর্মচারী বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারে বসবাস করতেন। সেখান থেকে এলাকার নামকরণ কেরানীগঞ্জ।
কেরানীগঞ্জ দ্বীপাকার বলে মোগল আমলের এক পর্যায়ে এই স্থানের নাম হয় পারজোয়ার। ঐতিহাসিকভাবে ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী এবং তাঁর খালা ঘসেটি বেগম কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় কারাবন্দী ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কৌশলগতভাবে বিশেষত গেরিলাযুদ্ধের ক্ষেত্রে কেরানীগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকা শহরে পরিচালিত অধিকাংশ গেরিলাযুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনা করা হয় কেরানীগঞ্জ থেকে। ইতিহাস থেকে ফিরে আসি কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদে।
ঐতিহাসিক এই মসজিদের অবস্থান কেরানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কোন্ডা ইউনিয়নের দোলেশ্বর গ্রামে। ১৫০ বছরের পুরোনো মসজিদটির পুরোনো স্থাপত্য ধরে রেখে নবাবি আমলের আদলে সুনিপুণ হাতে সংস্কারকাজ করেছেন স্থপতি সাঈদ মোস্তাক আহমেদ।
মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লি হামিদ মিয়ার কাছ থেকে জানা যায়, মরহুম দারোগা আমিনউদ্দিন আহাম্মদ বাংলা ১২৭৫ সনে (ইংরেজি ১৮৬৮, হিজরি ১২৮৫) নিজ উদ্যোগে অনন্য স্থাপত্যশৈলীর এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। জনশ্রুতি আছে, দারোগা আমিনউদ্দিন আহাম্মদ মসজিদটির নির্মাণে প্রথম উদ্যোক্তা হওয়ায় এটি দারোগা মসজিদ নামে পরিচিত ছিল, এখনো এই নাম বললে এলাকাবাসী এই মসজিদ দেখিয়ে দেন। দারোগা আমিনউদ্দিন আহাম্মদের ছেলে মইজউদ্দিন আহম্মদ ছিলেন মসজিদের প্রথম মোতোয়ালি।
মইজদ্দিন আহাম্মদ, তমিজউদ্দিন আহাম্মদ, করিমউদ্দিন আহাম্মদ, খিদির বক্স মিয়া ও আবদুর গফুর আহাম্মদ মসজিদটির জন্য জমি ওয়াক্ফ করেন। মসজিদের সামনের ফলকের তথ্য অনুযায়ী, সহোদর খিদির বক্স ও কাদের বক্স ও মইজউদ্দিন আহাম্মদের পরিবার বংশপরম্পরায় মসজিদটির নির্মাণ ও সংস্কারকাজে জড়িত ছিলেন। কাদের বক্সের নাতি ও হাফেজ মো. মুছার ছেলে তৎকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান মসজিদটির বর্ধিত অংশ ১৯৬৮ সালে নির্মাণ করেন। এরপর একাধিকবার মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়।
কালের আবর্তে এই মসজিদের অবকাঠামো বিলীন হওয়ার পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। মসজিদটিকে সংস্কার করে পুরোনো রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেন তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ। তাঁর উদ্যোগে স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ মসজিদ অবকাঠামো ঠিক রেখে পুনঃসংস্কারের কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে সংস্কারকাজ শেষ হয়।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে, এমনকি দেশ-বিদেশ থেকেও পর্যটকেরা কেরানীগঞ্জের হানাফিয়া জামে মসজিদটি দেখতে আসেন।
পুরো মসজিদটির রং লাল সুরকির মতো। মসজিদের উপরিভাগে আছে দুটি গম্বুজ এবং নয়টি মিনার। মসজিদের অভ্যন্তরীণ স্থাপত্যে অনুসরণ করা হয়েছে মোগলদের রীতি। ভেতরে আছে দুটি দৃষ্টিনন্দন মিহরাব। বড় মিহরাবে সাদা রঙের মোটিফে লাল ইটের সমন্বয় নান্দনিক। ইমাম নামাজ পড়ানোর স্থানে দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন পাতার নকশা। মসজিদের দেয়ালে আছে ছোট ছোট ঘরসদৃশ খোপ।
দরজার খিলান খোপের আদলে করা। কাঠের দরজায় লোহার পাত দিয়ে আংটা করা হয়েছে। দরজায় আছে কাঠের খিল ও ছিটকিনি, গ্রামের বাড়িতে দরজায় এখনো এমন খিল ও ছিটকিনি দেখা যায়। ভেতরের সব দরজা-জানালা কাঠ দ্বারা নির্মিত। দরজার নকশা খুবই সুন্দর। মসজিদের দক্ষিণ প্রান্তে একটি জানালা এবং উত্তর প্রান্তে তিনটি জানালা আছে। ভেতরে যাতে প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহ ঠিক থাকে, পর্যাপ্ত আলো ঢোকে এবং সব ঋতুতে সহনীয় তাপমাত্রা বজায় থাকে সেই উদ্দেশ্যে জানালা নির্মিত হয়েছে বিশেষ পদ্ধতিতে। মসজিদ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়নি কোনো সিমেন্ট। মসজিদটি পুনর্নির্মাণে পুরোনো আদলে ইট–সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ট্রান্সপারেন্ট সিলিকন।
পুরোনো মসজিদের পাশেই নির্মাণ করা হয় নতুন আরেকটি মসজিদ। পুরোনো মসজিদটি বর্তমানে গ্রন্থাগার ও মক্তব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদের ছবি তুলতে গিয়ে দেখা গেল, বিকেলে শিশুরা মসজিদ প্রাঙ্গণে খেলাধুলা করছে। সেখানে থাকা মাদ্রাসাশিক্ষার্থী খালিদ মহসিন জানালেন, শুক্রবারে সবচেয়ে লোকসমাগম বেশি হয়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ দেখতে আসে মসজিদ।
২০২৩ সালে কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ পরিদর্শন করতে আসেন সৌদি রাষ্ট্রদূত ইসা বিন ইউসেফ বিন আল-দুহাইলান। ২০২১ সালে ইউনেসকো এশিয়া-প্যাসিফিক অ্যাওয়ার্ডস ফর কালচারাল হেরিটেজ কনজারভেশনে ৬টি দেশের ৯টি স্থাপনাকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
এর মধ্যে ‘অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’ ক্যাটাগরিতে স্বীকৃতি পায় কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ। পাশের লাল মসজিদটি একই বছর সৌদি আরবের আবদুল লতিফ ফাওজান আন্তর্জাতিক ‘মসজিদ স্থাপত্যশিল্পবিষয়ক অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে। পুরোনোকে ধরে রেখে নতুন আদলে নির্মাণ করলে টিকে থাকবে এমন পুরাকীর্তিগুলো। এভাবেই সংরক্ষিত হোক বাংলার আনাচে-কানাচে টিকে থাকা সুলতানি-মোগল আর নবাবদের ইমারত কিংবা জমিদারবাড়িগুলো।
ছবি: শিশির চৌধুরী