শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্থাপত্যশিল্প প্রতিযোগিতা ‘দ্য ইন্সপাইরেলি অ্যাওয়ার্ডস’। এই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশের ৯২১ জন প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন এমআইএসটির শিক্ষার্থী সারাফ নাওয়ার। তাঁর এই একাডেমিক প্রজেক্টের মূল ধারণা টেকসই ও পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য নির্মাণ।
তরুণ স্থাপত্য–শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্থাপত্যশিল্প প্রতিযোগিতা দ্য ইন্সপাইয়ারলি অ্যাওয়ার্ডসে বাংলাদেশের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী সারাফ নাওয়ার স্থাপত্য বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে স্থাপত্যের শিক্ষার্থীরা এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এটা ছিল প্রতিযোগিতার নবম আসর।
এবারের প্রতিযোগিতায় সারাফ জমা দিয়েছিলেন তাঁর স্নাতকের থিসিস প্রজেক্ট। বাংলাদেশের সোনাদিয়া দ্বীপে টেকসই জলজ স্থাপত্য নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল তাঁর প্রজেক্টের বিষয়। মূল শিরোনাম ‘টেল অব অ্যান ওশান: ওশানেরিয়াম কমপ্লেক্স অ্যাট সোনাদিয়া’। দ্য ইন্সপাইরেলি অ্যাওয়ার্ডসের আগে আরও দুটি পুরস্কার পেয়েছে সারাফের এই প্রজেক্ট।স্থাপত্য, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা—এই তিন বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয় এ প্রতিযোগিতায়। সারাফ স্থাপত্য বিভাগে প্রথম বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে পুরস্কারটি পেয়েছেন।
এর আগে দ্য ইন্সপাইরেলি অ্যাওয়ার্ডসের পঞ্চম আসরে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল বিজয়ী হয়েছিল। এবার তিন বিভাগে মোট ১ হাজার ১৭৪টি প্রজেক্ট জমা পড়েছিল ৮৭টি দেশ থেকে। স্থাপত্য বিভাগে ৯২১টি প্রজেক্ট জমা পড়ে ৮৫টি দেশ থেকে। নির্বাচিত ফাইনালিস্ট তালিকায় ৩০ জনের মধ্যে বাংলাদেশের আরও ২ শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁরা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইমা রহমান ও মোহাম্মদ কাফি উদ্দিন। স্থাপত্যকলার এই অর্জন আমাদের দেশে স্থাপত্যবিদ্যা এবং পরিবেশে স্থাপত্যের টেকসই ডিজাইনকে অনুপ্রাণিত করবে।
এই অর্জনের সূত্র ধরে কথা হয় সারাফ নাওয়ারের সঙ্গে। সারাফ বলেন, ‘এক হাজারের বেশি নির্বাচক থাকেন এই প্রতিযোগিতায়। বুঝতে পারিনি জিতে যাব। এই প্রজেক্ট আমার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। মাস্টার্স যদি কখনো করা হয়, তাহলে সেখানেও টেকসই স্থাপত্য নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে আমার।’
‘টেল অব অ্যান ওশান: ওশানেরিয়াম কমপ্লেক্স অ্যাট সোনাদিয়া’—এই প্রজেক্টে সারাফের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশগত সংকটপূর্ণ ও জটিল সমস্যাসংকুল এলাকা সোনাদিয়া দ্বীপের জন্য উপযুক্ত আধুনিক ও টেকসই জলজ স্থাপত্য নির্মাণ। প্রকল্পটি যেমন আধুনিক, তেমনি নান্দনিক। সোনাদিয়া দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের পাড়ে। তিন দিকে সমুদ্র ঘেরা এই চরাঞ্চলে আছে বালিয়াড়ি, ম্যানগ্রোভ বন, মোহনা, দুর্লভ জীববৈচিত্র্য আর প্রতিদিনের জোয়ার–ভাটা। অসংখ্য প্রাণীর বসবাস এখানে। এখানে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী আছে ৫০ ধরনের। পরিবেশগত অসামঞ্জস্যের কারণে এ অঞ্চলে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। বাস্তুসংকটাপন্ন এই দ্বীপে স্থাপত্য নির্মাণ করা এবং টিকিয়ে রাখাটাই অনেক চ্যালেঞ্জিং বলে জানান সারাফ নাওয়ার।
সারাফ ওশানেরিয়ামটি এমনভাবে ডিজাইন করেছেন, যা স্থানীয় ম্যানগ্রোভ বন ও বাস্তুতন্ত্রের কোনো ক্ষতি তো করবেই না; বরং বিপন্ন প্রজাতির উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। দ্বীপের একপাশের কমপ্লেক্সে থাকবে সল্ট ওয়াটার অ্যাকুয়ারিয়াম, ফিশ অ্যাকুয়ারিয়াম, ডলফিনেরিয়াম ও ওশান হেরিটেজ মিউজিয়াম। এর উত্তর-পূর্ব পাশে ম্যানগ্রোভ বন, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক ব্লক আর সঙ্গে একটি ক্যাফেটেরিয়া। এই ওশানেরিয়ামের দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে সাগর।
এই প্রকল্পের গবেষণাকেন্দ্রটি সামুদ্রিক ও ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম রক্ষা করার জন্য কাজ করবে। অভিনব এই ওশানেরিয়াম সামুদ্রিক প্রাণী উদ্ধার করার পাশাপাশি প্রচলিত অ্যাকুয়ারিয়ামের পরিবর্তে একটি আউটডোর প্রাকৃতিক প্রদর্শনী হিসেবেও কাজ করবে। প্রজেক্টে শক্তিসাশ্রয়ী, টেকসই ও লাইটওয়েট নির্মাণ পদ্ধতি ব্যবহারের পরিকল্পনা দিয়েছেন সারাফ। এটি সোনাদিয়ার বালিয়াড়ি ও মাটির লবণাক্ততা, নিয়মিত জলোচ্ছ্বাস, মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়সহ সার্বিক জলবায়ুর জন্য উপযুক্ত হবে।
প্রতিদিন জোয়ারের সময় এখানে লবণাক্ত পানি সংগৃহীত হবে। সেই পানি বাষ্প হয়ে লবণ চলে যাবে স্থানীয় লবণ তৈরির কারখানায় আর পরিশোধিত পানি আলাদা জমা হবে। পুরো এই ওশানেরিয়ামের জন্য প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ শক্তি পাওয়া যাবে সৌরবিদ্যুৎ থেকে। পানির স্তর ওপরে উঠে গেলে এখানকার মডিউলার সিস্টেমগুলো ডিমাউন্ট করা যাবে।
প্রচলিত বিল্ডিং তৈরির সামগ্রী লবণাক্ত পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে এবং বেশি দিন টেকসই হয় না। প্রতিদিনের জোয়ার-ভাটার পানিতে স্থাপনা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য ফেরোরক নামে একটি কাঁচামাল ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছেন সারাফ, যা পানিতে নষ্ট হয় না। তিনি বলেন, ৯৫ শতাংশ রিসাইকেলড এই কাঁচামাল একাধারে সাশ্রয়ী ও কম কার্বন উৎপাদনকারী। কংক্রিটের চেয়েও দৃঢ়, স্থিতিস্থাপক ও ‘সেলফ ক্লিনিং’ প্রযুক্তি যোগ করা হয়েছে এ পরিকল্পনায়। এটি পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হতে পারে।
ছবি: সারাফ নাওয়ার