শতবর্ষী কাজীবাড়ি: সুলতানি আমলের মসজিদ ও জমিদারি ভোজ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পুরান ঢাকার রোকনপুরে রয়েছে শতবর্ষী কাজীবাড়ি। সেই বাড়িতে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নতুন প্রজন্ম ও বিদেশিদের কাছে তুলে ধরার জন্য চালু হয়েছে উদ্যোগ ‘কাজীবাড়ি হেরিটেজ এস্টেট’। ইতিহাস–ঐতিহ্যের সঙ্গে সেখানে আছে জমিদারি ভোজের সুযোগ।

পুরান ঢাকার শতবর্ষী কাজীবাড়ি
পুরান ঢাকার শতবর্ষী কাজীবাড়ি

গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার থেকে নর্থ সাউথ রোড় ধরে সদরঘাটের দিকে যেতে গেল পড়ে তাঁতীবাজার মোড়। এই মোড় থেকে হাতের বাঁয়ে গেলে রায়সাহেব বাজার চৌরাস্তা। চৌরাস্তা পার হয়ে সোজা ৫০০ মিটার সামনে রাস্তার বাঁয়ে হাজি মাইজুদ্দীন মার্কেট পড়বে। এর উল্টো দিকে (অর্থাৎ বড় রাস্তা থেকে ডান দিকে) পাঁচভাই লেন। গলিতে ঢুকলেই আপনি রাস্তার ওপর অনেক টায়ার দেখতে পাবেন। এখানে অনেক টায়ারের দোকান আছে। গলিতে ১০০ মিটার গেলেই একটি সুপারশপ। সুপারশপের উল্টো দিকের ছোট গেটটাই কাজীবাড়ি হেরিটেজ এস্টেটের। কাজীবাড়ি নামে চেনেন সবাই। যে কারও কাছে জানতে চাইলে আপনাকে দেখিয়েও দেবেন।

বিজ্ঞাপন

 গেট দিয়ে ঢুকেই হাতের বাঁয়ে দেখবেন পুরোনো বনেদি আমলের দুটি ভিন্টেজ গাড়ি। এর একটি ভক্সওয়াগন, অন্যটি টয়োটা। এগুলো হাতের বাঁয়ে রেখে এগোলেই তিনটি বাঁধানো কবর দেখবেন। এর আগেই আপনি পাবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসবেন। দুই সমতলের দুটি বাড়িকে একটি করিডর দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে। উত্তর দিকে এগোলেই আপনি দোতলার একটি খোলা জায়গায় এসে পড়বেন। এরপরই আপনার চমক লাগা শুরু। আপনার সামনে উন্মোচিত হবে ১৮২০ সালের আগে নির্মিত কাজীবাড়ির মূল ভবন।

কাজীবাড়ির মসজিদ
কাজীবাড়ির মসজিদ

আপনি যে গেট দিয়ে ঢুকেছেন, সেটি এই শতবর্ষীয় কাজীবাড়ির মূল দরজা নয়। সেটি আসলে খিলান দরজা। কারণ, বাড়িটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত, যার সামনের দক্ষিণ দিক খোলা। দোতলার মূল বাড়িতে রয়েছে একাধিক কক্ষ। এর কয়েকটিজুড়ে এখন কাজীবাড়ি হেরিটেজ এস্টেটের আয়োজন। খোলা জায়গা থেকে বাড়িতে ঢোকার দুটি দরজা। পূর্ব দিকের মূল দরজা আপনাকে একটি বারান্দায় নিয়ে যাবে। বারান্দা থেকে আপনি যেতে পারবেন কাজীবাড়ির অন্দরমহলের ড্রয়িং রুমে কিংবা পাশের ঘরে, যেখানে একটা টেবিল পাতা। ড্রয়িং রুমের সোফা ও অন্যান্য আসন পাতা। সেখানে গেলে আপনাকে স্বাগত জানানো হবে লেবুর শরবত দিয়ে।

বিজ্ঞাপন

 শরবত খেয়ে আপনি শুরু করতে পারেন এদিক–ওদিক যাওয়া। প্রথমেই আপনি পাশের লম্বা হলরুমে গিয়ে দেখবেন একটি জমিদারি খাট। বর্তমান খাটের তুলনায় এটি বেশ উঁচু। লাল জরির কাপড় দিয়ে এটিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আপনারা যদি দলেবলে বেশি হন, তাহলে সেই রুমে আপনাদের আহারের ব্যবস্থা করা হবে এবং সে ক্ষেত্রে আপনি কাজীবাড়ির বনেদি খাবার টেবিলটি দেখতে পাবেন না।

সাজানো রয়েছে ব্যবহার্য সামগ্রী
সাজানো রয়েছে ব্যবহার্য সামগ্রী

হলরুমের নানা স্থানে কাজীবাড়ির নানা ঐতিহ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে আপনি পাবেন জাপানি সামুরাইদের তলোয়ার, দেখবেন আমাদের ঐতিহ্যবাহী নানা কিছু। হলরুমের আলমিরাগুলোও আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করবে তাদের কারুকার্যের জন্য। হলরুমের পুব দিকে পড়ার ঘর। সেখানে দেয়ালজোড়া তাকে অনেক বই। পুরোনো অনেক বইও আপনি সেখানে দেখতে পাবেন।

খোলা জায়গা থেকে আপনি দেখবেন বাড়ির আঙিনায় একটি মসজিদ। মসজিদের স্থাপত্য সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকলে টের পাবেন এটি সুলতানি আমলে নির্মিত। কাজীবাড়ির একেবারে নিজস্ব এই মসজিদের মূল নামাজঘরে ২০ জন নামাজ পড়তে পারেন। পরবর্তী সময়ে একটি বারান্দা করা হয়, যেখানে আরও অন্তত ২০ জনের নামাজ পড়ার সুযোগ হয়েছে। তবে শুক্রবার বাড়ির চৌহদ্দিতে শতরঞ্জি পেতে জুমার নামাজ আদায় করেন আশপাশের অনেকে।

এ যেন এক জাদুঘর
এ যেন এক জাদুঘর

যে করিডর ধরে মূল ভবনে এসেছেন, এর দক্ষিণ দিকে আর একটি কক্ষ। সেখানে আছে একটি বালিশ ও বনেদি আমলের হুঁকা। সেটি পেরিয়ে ছোট একটি বারান্দা, যেখানে একটি ঝুল দোলনা আর চেয়ার। আড্ডা দেওয়া যায়। সেগুলো পেরিয়ে আপনি ইচ্ছে করলে কাজীবাড়ির দহলিজ অংশের ছাদে আড্ডা দিতে পারবেন। কিংবা সেখানে দাঁড়িয়ে জমিদারবাড়ির ছবি তুলতে পারবেন।  

ভালো কথা, এই কাজীবাড়ির অন্যতম সন্তান হলেন স্বাধীনতা পদকজয়ী ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক ও প্রশিক্ষক কাজী আবদুল আলীম। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি ধারাবাহিকভাবে ৯ বছর প্রাদেশিক অ্যাথলেটিকস এবং ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সাত বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল অ্যাথলেটিকসে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। এর মধ্যে কাজী আবদুল আলীম ১৯৫১ সালে পোলভল্টে পাকিস্তানের জাতীয় রেকর্ড ভাঙেন। তিনি ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিক দলের অধিনায়ক এবং ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় প্রশিক্ষক ছিলেন। অন্দরমহলের ড্রয়িং রুমে আপনি তাঁর স্বাধীনতা পদক ও অন্য পুরস্কারগুলো দেখতে পাবেন।

ডাইনিং টেবিলে সাজনো খাবার দেখছেন লেখক
ডাইনিং টেবিলে সাজনো খাবার দেখছেন লেখক

শতবর্ষী এই কাজীবাড়িতে কাজী সাদ আলীম গড়ে তুলেছেন ঘরোয়া আয়োজন—কাজীবাড়ি হেরিটেজ এস্টেট। আগে থেকে বুকিং করে কমপক্ষে ছয়জনের দল সেখানে যেতে পারে, দুপুরের খাবার খাওয়া ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় হতে।

সাদ আলীম জানালেন, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই তাঁর এই উদ্যোগের লক্ষ্য। মেহমানদের এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি নিজে। ঘরোয়া এই আয়োজনে খাবার একটি বাড়ির অনুষঙ্গমাত্র। সে জন্য খাবারের সেট মেনু তিনি রেখেছেন। খাবারের মেনুর মধ্যে রয়েছে শাহি পোলাও, নান, চিকেন রোস্ট, মাছভাজি, শাহি আলুর চপ, চায়নিজ সবজি, সালাদ, কোনো একটা ভাজি। ডেজার্ট হিসেবে থাকে মিষ্টি, জর্দা কিংবা ফিরনির যেকোনো একটা। এই মেনুর খরচ পড়ে প্রতিজন ৮০০ টাকা। এর সঙ্গে শাহি গরুর মাংস কাটা মসলায় রান্না ও চিংড়ির মালাই কারি যোগ করা যায়। তাতে খরচ পড়বে জনপ্রতি ১২০০ টাকা।

শতবর্ষী কাজীবাড়ি দেখতে এসেছেন দেশি–বিদেশি অতিথিরা
শতবর্ষী কাজীবাড়ি দেখতে এসেছেন দেশি–বিদেশি অতিথিরা

ছুটির দিনে ছয়জনের একাধিক গ্রুপ সেখানে যাওয়া যায়। প্রতিটি গ্রুপকে আলাদাভাবেই ইতিহাস–ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

যেতে চাইলে আগেভাগে বুকিং করে যেতে হয়। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করতে হবে এই (017-467-48104) নম্বরে অথবা যোগাযোগ করতে পারেন তাদের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে।

ছবি: কাজিবাড়ি হেরিটেজ স্টেট

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩: ৩০
বিজ্ঞাপন