ঈদগাহ মূলত একটি উর্দু শব্দ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যেকোনো খোলা স্থানকে বোঝানোর ক্ষেত্রে এ শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কয়েকটি ঈদগাহের খোঁজ থাকল এবার।
এটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত এক মোগল ঈদগাহ। ঢাকার ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে প্রাচীন এই ঈদগাহটি মোগল শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত হয়; যা এখন ধানমন্ডি ঈদগাহ নামেও পরিচিত। ধানমন্ডির পুরোনো ১৫ ও নতুন ৮/এ সড়কে এর অবস্থান। প্রায় চার শ বছর আগে তৎকালীন বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজার আমলে তাঁর দেওয়ান মীর আবুল কাসিম এই ঈদগাহ নির্মাণ করেন। তখন শুধু মোগলরাই এই ঈদগাহে যেতেন। এই তথ্যটি ঈদগাহের কেন্দ্রীয় মেহরাবের শিলালিপিতে উল্লেখ করা আছে। ঐতিহাসিকদের মতে, উনিশ শতকের শেষের দিকে শহরের অন্য মুসলমানরা এখানে ঈদের নামাজে অংশ নিতে শুরু করেন। এ সময়ে সেখানে ঈদের মেলাও বসত। সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বিখ্যাত স্থপতি আবু সৈয়দ এম আহমেদকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, ‘মোগল আমলে নির্মিত এই ঈদগাহের মতো স্থাপত্যকলার নিদর্শন আর একটিও নেই। ১৯৮১ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করছে। এবারের ঈদের নামাজ আদায়ে চলে যেতে পারেন মোগল স্মৃতিবিজড়িত এই প্রাচীন ঈদগাহে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈদগাহ চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ ঈদগাহ ময়দান। এখানে একসঙ্গে ৩০,০০০ হাজার মুসল্লি ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারে। দুই পর্বে ৬০ হাজারের মতো মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন। চারপাশে সীমানা প্রাচীর আছে মাঠজুড়ে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ওয়াসা মোড় এলাকায় আছে জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ। এই মসজিদের সামনে বিশাল ঈদগা মাঠ। এই মাঠেই দুই ঈদের জামাত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রতিবছর দুই ঈদের সময় চট্টগ্রামজুড়ে কোন মসজিদ বা মাঠে কখন ঈদ জামাত হবে এমন একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় জমিয়তুল ফালাহ ঈদগাহ মাঠের সময়সূচি থাকে সবার আগে। কয়েক যুগ ধরে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত এই মাঠেই হয়ে থাকে। ঈদের দিন এই ময়দানে চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের জমায়েত হয়।
১৯৮৯ সনে প্রথম জমিয়তুল ফালাহ ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের খতিব আল্লামা আবদুল আহাদ আল মাদানী (রহ.) ওই বছর ঈদ জামাতে ইমামতি করেন। চট্টগ্রামের এই বৃহত্তম ঈদগাহ ময়দানে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক ইসলামিক কনফারেন্স, সুফি সম্মেলন থেকে শুরু করে বড় বড় ইসলামিক আয়োজনগুলো এই ঈদগাহ মাঠেই অনুষ্ঠিত হয়। জমিয়তুল ফালাহ ঈদগাহ ময়দানে বিশ্বের বড় বড় ইসলামিক আলেমরা এখানে এসে বক্তৃতা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম তথা সারা বিশ্বে এই ময়দান বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।
এখানে প্রথম খুতবা পড়েছিলেন মসজিদের প্রথম খতিব অধ্যক্ষ আল্লামা জালাল উদ্দীন আলকাদেরী (রহ.)। পরবর্তীতে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের খতিবরাই এখানে ঈদ জামাতে ইমামতি করে আসছেন। এছাড়াও চট্টগ্রামে আরও আছে লালদীঘি ঈদগাহ ময়দান, কাটগড় ঈদগাহ ও বদ্দারহাট চাঁদগাও আবাসিক সংলগ্ন ঈদগাহ।
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাতকে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত বলা হয়ে থাকে। প্রায় ২০০ বছর ধরে ঈদের নামাজের বিরাট জমায়েত এখানে হয়ে আসছে। শুধু শোলাকিয়া ময়দান নয়, ঈদের নামাজের সময় জনসমাগম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বিশাল এলাকায়ও। ১৮২৮ সালে এই মাঠে প্রথম অনুষ্ঠিত ঈদের জামাতের তথ্য পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হজরত খান বাহাদুর জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে এই ঈদগাহের সূচনা করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, শোলাকিয়ার সাহেববাড়ির সুফি সৈয়দ আহম্মদ ১৮২৮ সালে তাঁর জমিতে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামাতের আয়োজন করেন। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে, ১৮২৮ সালে প্রথম জামাতে সোয়া লাখ মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন বলে এ মাঠের নামকরণ করা হয়েছিল ‘সোয়া লাখি মাঠ’। সেখান থেকেই কালক্রমে এটি পরিচিত হয়ে ওঠে শোলাকিয়া মাঠ হিসেবে। ঈদগাহ কর্তৃপক্ষের হিসাবে, শুধু মাঠের ভেতরেই প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজে অংশ নিতে পারেন। আশপাশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে মানুষ এসে এখানে ঈদের নামাজে অংশ নেন। এমনকি রাজধানী ঢাকা থেকে বিশেষ ট্রেনেও অনেকে সেখানে যান ঈদের নামাজে অংশ নিতে।
শোলাকিয়ার মতো প্রাচীন না হলেও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুরের এ ঈদগাহ মাঠটি আলোচনায় আছে কয়েক বছর ধরে। কারণ, এ ঈদগাহকে অনেকে বর্তমানে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ ময়দান বলে উল্লেখ করে থাকেন। প্রায় ২২ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এ ঈদগাহের মিনার বেশ দৃষ্টিনন্দন। ৫৩ গম্বুজের এই মাঠে একসঙ্গে ১০ লাখ মুসল্লি নামাজে অংশ নিতে পারবেন বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করে। মোগল রীতি অনুসরণ করে তৈরি হলেও এটি খুব বেশি পুরোনো নয়। গোর–এ–শহীদ ময়দানের পশ্চিম দিকের প্রায় অর্ধেক জায়গাজুড়ে এই ঈদগাহের মিনার। যদিও দেশ বিভাগের পর থেকেই এ মাঠে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হতো। কিন্তু সেটিকে ঈদগাহ হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। পরে নতুন করে ২০১৫ সালে ঈদগাহ মিম্বার নির্মাণের মাধ্যমে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদগাহ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। তবে এ মাঠটির নামকরণ গোর–এ–শহীদ বড় ময়দান হয়েছে মূলত ইসলাম প্রচারক শাহ আমির উদ্দিন ঘুরী (রহ.)–এর নামে। তিনি দিনাজপুর অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং এখানেই তাঁর মাজার আছে।
হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকের ভাষ্যে, শাহ মখদুম ঈদগাহ ময়দান গড়ে উঠেছে রাজশাহীতে শাহ মখদুমের (রহ.) দরগাহকে কেন্দ্র করেই। ইসলাম প্রচারে বাগদাদ থেকে আসা তুরকান শাহ (রহ.)–এর মাজারকে কেন্দ্র করে দরগাহ এলাকা গড়ে উঠেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর শাহ মখদুমসহ আরও কয়েকজন এ অঞ্চলে এসে ইসলাম প্রচার করেছেন। শাহ মখদুম (রহ.) এই দরগাহতেই মসজিদ তৈরি করেন এবং পরে সেখানেই তাঁদের সমাহিত করা হয়। ১৬৩৪ সালে এখান থেকেই দরগাহ ও ঈদগাহের ভিত্তি তৈরি হয়। পরে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাজশাহী নগরীর কেন্দ্রস্থল পদ্মার তীর ঘেঁষে রাজশাহীর বর্তমান হজরত শাহ মখদুম (রহ.) কেন্দ্রীয় ঈদগাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ঈদগাহের ভূমি উঁচু ও সমতল করা হয়। এরপর আধুনিক স্থাপত্যের পাঁচ ফুট উঁচু বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। ২০১৩ সালে ঈদগাহ মাঠের আয়তন প্রায় দ্বিগুণ করা হয়। মাঠে প্রবেশের জন্য আছে ছোট–বড় অন্তত ছয়টি প্রবেশপথ।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন বলছে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ের সিলেটের মোগল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ এই ঈদগাহ নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক এই ঈদগাহ ১৭০০ সালের প্রথম দিকে নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি গাছপালা ঘেরা এ ঈদগাহের অবস্থান সিলেট নগরীর মধ্যবর্তী এলাকায়। প্রাচীন এই নিদর্শনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা। ১৭৭২ সালে ইংরেজবিরোধী ভারত-বাংলা জাতীয়তাবাদী প্রথম আন্দোলন এখান থেকেই শুরু হয়। একটি টিলার ওপর ঈদগাহটির মূল অংশ আর বিশাল মাঠের চারদিকে আছে সীমানাপ্রাচীর। ঈদগাহ ময়দান থেকে মূল অংশে যেতে হলে অতিক্রম করতে হয় বাইশটি সিঁড়ি। প্রতিবছর এই ঈদগাহে সেখানকার প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদগাহে ঢোকার জন্য আছে তিনটি ফটক। পূর্ব দিকে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পুকুরে মুসল্লিদের জন্য অজুর ব্যবস্থা। মোগল স্থাপত্যরীতিতে হলেও পরে এর কিছুটা পরিবর্তনও হয়েছে। যোগ হয়েছে প্রায় ২০০ ফুট উঁচু মিনার এবং তিন দিকে তিনটি বিশাল তোরণ।
চট্টগ্রামের তথ্য : কমল দাশ
ছবি: সংগৃহীত