ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত মোগল শাসনের ধারাবাহিকতায় যে স্থাপত্যরীতি প্রচলিত রয়েছে, তারই নিদর্শন সাতগম্বুজ মসজিদ। ধারণা করা হয় ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ মসজিদটি নির্মাণ করেন। অন্য এক তথ্যে জানা যায়, নবাব শায়েস্তা খাঁর বড় ছেলে বুজুর্গ উদ্দিন (উমিদ খাঁ) এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে আছে। মসজিদটি লালবাগ দুর্গ মসজিদ এবং খাজা আম্বর মসজিদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কোম্পানি আমলে ধানমন্ডি এলাকা জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে গেলে এই মসজিদ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে নবাব আহসানউল্লাহ মসজিদটি সংস্কার করে একজন মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেছিলেন।
এর ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ এবং চারটি কোণের প্রতিটি কোণে একটি করে ছোট গম্বুজ থাকায় একে সাতগম্বুজ মসজিদ বলা হয়। আয়তাকার নামাজ পড়ার স্থানে বাইরের দিকের আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৭ দশমিক ৬৮ এবং প্রস্থে ৮ দশমিক ২৩ মিটার। এর পূর্ব দিকের দেয়ালে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলান এটিকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
পশ্চিম দিকের দেয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে। দূর থেকে মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর দেখায়। মসজিদের ভেতরে ৪ কাতারে প্রায় ৯০ জন নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদের পূর্ব দিকে এরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে একটি সমাধি। কথিত আছে, এটি শায়েস্তা খাঁর মেয়ের। সমাধিটি ‘বিবির মাজার’ বলেও খ্যাত। এ কবর কোঠাটি ভেতর থেকে অষ্টকোণ আকৃতির এবং বাইরের দিকে চতুষ্কোণ আকৃতির। বেশ কিছুদিন আগে সমাধিক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল। বর্তমানে এটি সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের সামনে একটি বড় উদ্যানও আছে। একসময় মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যেত বুড়িগঙ্গা নদী। মসজিদের ঘাটেই ভেড়ানো হতো লঞ্চ ও নৌকা; কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা কল্পনা করাও কষ্টকর। বড় দালানকোঠায় ভরে উঠেছে মসজিদের চারপাশ।
প্রায় সাড়ে তিন শ বছরের পুরোনো আম্বর শাহ শাহি মসজিদ। এটি কারওয়ান বাজারে। আশপাশে গড়ে ওঠা বহুতল ভবনের কারণে এই স্থাপনা দিন দিনই নগরবাসীর দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তীর ঢাকা’ গ্রন্থের মাধ্যমে জানা যায় কারওয়ান বাজারের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনার নাম। এই মসজিদকে বলা হয়, কারওয়ান বাজারের ঐতিহ্য এবং এটিকে এই এলাকার সবচেয়ে পুরোনো স্থাপনা বলে অভিহিত করেছেন ইতিহাসবিদেরা। মোগল আমলে এখানকার সরাইখানায় পথিক আসতেন বিশ্রাম নিতেন। তাঁদের অনেকেই এই মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। মসজিদটির নির্মাণশৈলী বেশ আকর্ষণীয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য কালো পাথরের তৈরি মেহরাব। মূল মসজিদটি আকারে ছোট হলেও এর সৌন্দর্য নজর কাড়ে মুসল্লিদের। আম্বর শাহ মসজিদের মূল ভবনের ওপরে শোভা পাচ্ছে তিনটি গম্বুজ।
এগুলো বাড়িয়েছে স্থাপনার বাইরের দিকের সৌন্দর্য। বিভিন্ন সময় সংস্কারের কারণে, মসজিদটির অনেক কিছুতেই পরিবর্তন হয়েছে। এর পরিসর বাড়ানোর পাশাপাশি আশপাশের স্থাপনার কারণে এখন সরাসরি দৃষ্টিগোচর হয় না মসজিদের মূল স্থাপনা। ঢাকার প্রাচীনতম মসজিদের তালিকায় এর অবস্থান ২২তম। ইতিহাস বলছে, মসজিদটির নির্মাণ সাল ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ। নির্মাতা খাজা আম্বর। তিনি সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রধান গুরু ছিলেন। মসজিদটিতে দুটি শিলালিপি আছে। কেন্দ্রীয় মেহরাবের ওপরে স্থাপিত প্রথম শিলালিপিতে আয়াত লেখা রয়েছে। আর কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের ওপরে বাইরের দিকে স্থাপিত দ্বিতীয় শিলালিপিতে লেখা আছে নির্মাণ সাল। তাছাড়া পার্সিয়ান ভাষায় লেখা একটি কবিতা দেখা যায় একটি ফলকে।
মসজিদটির নির্মাণশৈলী অত্যন্ত আকর্ষণীয় কারুকাজময়। তিন গম্বুজের এ মসজিদ ভূমি থেকে প্রায় ১২ ফুট উঁচু একটি উত্তোলিত মঞ্চের পশ্চিম অর্ধাংশজুড়ে অবস্থিত। এ ভিত্তিমঞ্চের শীর্ষে রয়েছে বদ্ধ পদ্ম-পাপড়ি নকশার একটি সারি। এর চারকোণে রয়েছে চারটি বিশাল আকৃতির পার্শ্ববুরুজ।অষ্টভুজাকৃতির বুরুজগুলো ভিত্তিমঞ্চের চেয়ে সামান্য একটু উঁচু এবং এগুলোর শীর্ষে রয়েছে ছোট ছোট গম্বুজ। পূর্ব প্রান্তে একটি সিঁড়ি পেরিয়ে পাথরের তৈরি ফ্রেমবিশিষ্ট খিলানযুক্ত একটি তোরণ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। এ সিঁড়িপথের ডান দিকে খাজা আম্বরের খননকৃত কূপটি ছিল, তবে বর্তমানে এটিকে মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ভিত্তিমঞ্চের পূর্ব দিকে রয়েছে খাজা আম্বরের সমাধি। আগে এখানে শুধু পাথরের তৈরি কবরফলক দৃশ্যমান ছিল। তবে বর্তমানে এর ওপরে ইট দিয়ে একটি ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে।
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন