
‘নকশাই সৃষ্টি করে সংস্কৃতি। সংস্কৃতিতেই পূর্ণতা পায় মূল্যবোধ। আর এই মূল্যবোধই গড়ে দেয় ভবিষ্যৎ।’
রবার্ট পিটারস
কিছুদিন আগে একটি প্রদর্শনী দেখতে দেখতে কানাডিয়ান ডিজাইনার রবার্ট পিটারসের এই কথাগুলো মনে হচ্ছিল। প্রদর্শনীটি আসবাবের। ফার্নিচার বললে আমাদের হাল প্রজন্মের জন্য সুবিধা হয়।

আসবাবগুলো বিভিন্ন সময়ের। বিভিন্ন শিল্পীর নকশায় তৈরি। প্রতিটি প্রয়োজনেই তৈরি। কিন্তু প্রতিটির গল্প আছে। আবার তাদের সুন্দর করে মুখোমুখি রাখা হয়েছে। তাতে মনে হতে পারে তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। নিজেদের সময়ের কথা আদান-প্রদান করছে।
এই প্রদর্শনীর নাম ছিল স্থিতি- অবজেক্ট ইন কনভারসেশন। আমরা জানি মানুষই কথোপকথন করতে পারে। করেও। কিন্তু জড়বস্তু সেটা করতে পারে, সেটা আমরা ভাবি না। কিন্তু এই প্রদর্শনীর তিন কিউরেটর বিশ্বজিৎ গোস্বামী, ডায়ান রিউ টেইলর ও উলরাইক ফেলনার আমাদের ভাবতে বাধ্য করেন।

ফলে এই সংলাপ আসবাবের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং সমাজের নানা ক্ষেত্রের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। তাঁরাও ভাবেন। তৈরি হয় যাঁর যাঁর মতো চিত্রকল্প। কিংবা সৃজনের অভিলাষ। আবার এসব প্রেরণাও হয়ে ওঠে বৈকি। আয়োজকদের উদ্দেশ্যও বোধ করি সেটা ছিল। অন্তত এ ক্ষেত্রে তারা সফল বলা যেতে পারে।
তবে দর্শক হিসেবে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমাদের স্থপতিদের তৈরি আসবাব। যেগুলো তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনেই তৈরি করিয়েছিলেন নিজেদের নকশা। না, সেটা কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়। অথচ বিভিন্ন সময়ে একেকজনের নকশা করা চেয়ার, টেবিল, স্টুল, শেলফ—এতটাই সমকালীন যে অবাক হতে হয়। প্রতিটি আসবাবের আবার গল্পও আছে। যেগুলো হৃদয়গ্রাহী। এসব কোনো কোনো আসবাবকে পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা যায়। সেটাও আইডিয়া হিসেবে দারুণ। আবার কার্যকরও। স্থপতিদের সঙ্গে আরও কিছু একজন দারুশিল্পীর তৈরির আসবাবও। সেগুলোও কম আকর্ষক নয়।

এবার দেখে নেওয়া যেতে পারে কাদের সৃজনকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল। তালিকা চোখ কপালে তোলার মতোই। কারণ, প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছিল স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, বশিরুল হক, শামসুল ওয়ারেস, কাজী খালিদ আশরাফ, নাহাস আহমেদ খলিল, সাইফ উল হক, বি কে এস ইনান, সালাউদ্দিন আহমদ, মেরিনা তাবাসসুম, নিতি মাহবুব, যুবায়ের হাসান, ডায়ান রিউ টেইলর, ভাস্কর তেজস হালদার জশ, চিত্রকর ওয়াকিলুর রহমান, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, রুফলাইনারস স্টুডিও অব আর্কিটেকচার, কারুশিল্পী আলমগীরের সৃজনকর্ম। আসলে প্রতিটি আসবাব সৃজনকর্ম বৈ তো নয়।
এসব আসবাব সৃষ্টির সংজ্ঞা মেনেই তৈরি হয়েছে। আবার আসবারের ব্যাকরণ, এর ব্যবহার উপযোগিতা কিন্তু কোনোভাবেই উপক্ষিত হয়নি। আবার দর্শনধারী বিষয়টিও ছিল ষোলো আনা। কিন্তু তার চেয়ে বেশি যেটা আমায় টেনেছে, তা হলো উপকরণের বৈশিষ্ট্যকে যথাযথ গুরুত্বে উপস্থাপন, আর প্রকৃতি, পরিবেশ, টেকসই ইত্যাদি বিষয়; যা আজকের পৃথিবীতে বড়ই সময়ানুগ।

তবে এই প্রদর্শনী দেখতে দেখতে আমার আরও একটি বিষয় মনে হয়েছে, সেটি বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ। আমাদের দেশে আসবাবশিল্প খাত যথেষ্ট সফল। স্থানীয়ভাবে যেমন উৎপাদন হচ্ছে, তেমনি বিদেশ থেকেও আমদানি হচ্ছে। অনেকেই নিজেদের ডিজাইনে যেমন তৈরি করছেন, তেমনি আবার অন্যের ডিজাইন অনুসরণ বা সরাসরি অনুকরণও হচ্ছে।
অথচ আমাদের কিংবদন্তি শিল্পী বা স্থপতিদের নিয়ে কেন কোলাবোরেশন হয় না, সেটা ভেবে অবাক হই। তাঁদের তৈরি ডিজাইনে তৈরি কোনো ফার্নিচার লাইনকে যথাযথ প্রচারণায় বাজরজাত করলে ক্রেতার অভাব হবে বলে আদৌ মনে হয় না। বরং সেই ডিজাইন অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পাবে বা আদৃত হবে বলেই আমার বিশ্বাস। উপরন্তু মৌলিক নকশায় তৈরি আসবাব বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

যাহোক, স্থিতি বস্তুত বাংলাদেশে আসবাবের সাংস্কৃতিক রূপকল্পকে প্রকাশ করা প্রথম ডিজাইন প্রদর্শনী। এখানে যেমন রয়েছে প্রজন্ম পরম্পরা, তেমনি বস্তুগত সম্পর্কের অন্বেষণও। তা ছাড়া এই প্রদর্শনীকে ভাবনা উসকে দেওয়ার অনুঘটক বললে বেশি বলা হয় না। কারণ, ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত ডিজাইনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক চিন্তাভাবনাও প্রকাশ পেয়েছে এই উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে।
তিনজন কিউরেটরও বিষয়কে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন, যার প্রশংসা না করে উপায় থাকে না। বিশেষত দুজন বিদেশি স্থপতি বাংলাদেশকে অনন্য অভিনিবেশে জেনেছেন, আত্তীকরণ করেছেন বলেই আরেকজন বাংলাদেশি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এই কাজটা করতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে এই ত্রয়ীর আবেগটাও লক্ষণীয়।
বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশন এই প্রদর্শনী আয়োজন করে অবশ্যই প্রশংসাহ্য হয়েছে। শিল্প ও সংস্কৃতিকে সৃজনের নানা মাত্রায় উপস্থাপনা, মেলবন্ধন রচনার কাজ করে যাচ্ছে বৃহত্ত্ব। সেটা তাদের প্রতিটি কাজেই প্রতিফলিত হয়। আর এই উদ্যোগ আসলে যে একটি সংলাপ-সূচনাকে উসকে দেওয়া, সেটা বলেছেন প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা নুসরাত মাহমুদ। তিনি মনে করেন, শিল্পী, ডিজাইনার, স্থপতি, কারুশিল্পী এবং গবেষকেরা কুশীলব হয়ে তাঁদের সৃজন ভাবনা বিনিময় করবেন; যেখানে সূত্রটা সানন্দে ধরিয়ে দিতে পারে বৃহত্ত্ব।
তবে ভবিষ্যতে এমন আরও প্রদর্শনীর সাক্ষী থাকার অপেক্ষা থাকবে সবার।
ছবি: বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশন