
শরতের আকাশে সাদা মেঘের সঙ্গে বাজে ঢাক। নাগরিক জীবনে পূজার মণ্ডপ পরিণত হয় সব ধর্মের উদ্যাপনে। বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে এ সময় পা রাখলেই ধূপের গন্ধ আর ঢাকের আওয়াজে ভেসে আসে বাতাসে।


এবারের গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশনের মণ্ডপে প্রবেশ করা মানেই যেন এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ। মাটির গন্ধ, জলের স্রোত, আগুনের দ্যুতি, বাতাসের মৃদু স্রোত আর আকাশের বিশালতা সব মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে এক অন্য রকম আবহ।


এবারের মণ্ডপের থিম ‘পঞ্চভূত: প্রকৃতির পাঁচ উপাদানে দেবী আরাধনা’। পার্থ প্রতীম সাহার শিল্পনির্দেশনায় মণ্ডপটি শুধু উৎসবের সাজসজ্জা নয়, যেন এক দার্শনিক অভিজ্ঞতা। শিল্পী পার্থ প্রতীম সাহা জানালেন, এবারের মণ্ডপ ভাবনানির্ভর নির্মাণশৈলীতে করা।
আগে থেকে হাতে–কলমে ছক নেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত নকশা। ১৮ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি পূজামণ্ডপ নিয়ে, এবারের মণ্ডপটি তাঁর ৩৬তম। শুরু থেকেই পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে তিনি পূজামণ্ডপ সাজিয়েছেন বলে জানান।


আরও বলেন, এবারের মণ্ডপের নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ এসেছে দেশের সাতটি জেলা থেকে। তারপর এখানে কারিগর আর কারুশিল্পীরা মিলে তাঁর নির্দেশনায় বানিয়েছেন মণ্ডপটি। পঞ্চভূতের পাঁচটি উপাদান হচ্ছে ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বাতাস) ও ব্যোম (মহাশূন্য)।

পার্থ প্রতীম আরও জানালেন, ‘প্রবেশপথের বাঁশ ও পাটকাঠির বুননে আর মাটির রঙে জেগে উঠেছে ক্ষিতি। শামিয়ানার কাছে দুলতে থাকা রঙিন ব্যানার অপের প্রতীক। সূর্যের আলো আর লাল কাঠামোয় তেজের প্রতীক জ্বলজ্বল করছে। খোলা আঙিনায় তুলা ও সাদা পাতার নকশায় প্রবাহিত হয়েছে মরুৎ; আর মণ্ডপের শীর্ষে জাজ্বল্যমান বৃত্তাকার আলোয় প্রতীয়মান হয়েছে ব্যোম বা মহাবিশ্বের শূন্যতা।’
কোনো সন্দেহ নেই প্রতিটি উপাদান শুধু দৃষ্টিগোচর করা নয়, হৃদয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো করে সাজানো হয়েছে। কারণ, পার্থর প্রতীমের ভাষায়, ‘এবারের মণ্ডপের বিশেষত্ব হলো পরিবেশবান্ধব উপকরণের ব্যবহার। বাঁশ, খড়, পাট, মাটি আর কাপড় সবই দেশীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা এবং প্রায় সবকিছুই জীবাণুবিয়োজ্য।

আরও বললেন, কারিগরেরা আর কারুশিল্পীরা এসেছেন সাত জেলা থেকে। সাতক্ষীরার বাঁশের বুনন, পিরোজপুরের হোগলা-মালই, বগুড়ার মাদুর, নড়াইলের পাটকাঠি, টাঙ্গাইলের লালমাটি, বাগেরহাটের কাঠ আর যশোরের চার রকম বাঁশ– সব একত্র হয়েছে মণ্ডপ নির্মাণে।
প্রতিমার পেছনে পদ্মাকৃতি দৃশ্যপটে ফুটে উঠেছে লোকশিল্পের ছোঁয়া। অলংকারের প্রতিটি রেখায় মাটি, শিকড় আর উত্তরাধিকারের রূপকথা বোনা হয়েছে।
ধূপের ধোঁয়া, আলো-অন্ধকারের খেলা, শিল্প আর প্রকৃতির সমন্বয়ে প্রতিফলিত হয়েছে সেই প্রাচীন মন্ত্র—সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে, শিবে সর্বার্থসাধিকে, শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী, নারায়ণী নমোস্তুতে।

ফাউন্ডেশনের সভাপতি জে এল ভৌমিক জানান, ‘দুর্গাপূজা শুধু পূজা নয়, এটি একসঙ্গে আনন্দ করার, সংস্কৃতি ভাগাভাগি করার আর ঐক্যের উৎসব। ১৮ বছর ধরে গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশন পরিবারগুলোকে একত্র করেছে। এ বছর আমরা মা দুর্গাকে বরণ করছি নতুন উদ্যমে, সংগীত, শিল্প আর ভক্তির মাধ্যমে; যাতে শান্তি ও সমৃদ্ধির বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।’

এভাবে গুলশান-বনানীর পূজামণ্ডপে প্রকৃতি, শিল্প, দর্শন আর ভক্তি মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে সব দর্শনার্থীর জন্য।
ছবি: পার্থ প্রতীম সাহা ও হাল ফ্যাশন