টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির ৭০০ বছরের প্রাচীন নবাব শাহি জামে মসজিদ মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলীর অপরূপ নিদর্শন বহন করে চলছে। ষোড়শ শতাব্দীতে সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ—এই দুই ভাই ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদের আদি অংশ এক কক্ষবিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি আছে, সম্রাট আকবরের সময় দুই ভাই ধনবাড়ির অত্যাচারী জমিদারকে পরাজিত করার পর এ অঞ্চলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
বাংলা ভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যুক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১১৫ বছর আগে এ মসজিদ সম্প্রসারণ করে আধুনিক রূপ দেন।
নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর প্রথম পুরুষ শাহ আতিকুল্লাহ বাগদাদ থেকে দিল্লিতে আসেন। তৎকালীন দিল্লির বাদশাহ তাঁর কাছে মুরিদ হন এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বসবাসের জন্য জায়গির প্রদান করেন। প্রথমে তিনি পাবনা জেলার নাকালিয়ায় বসবাস করতে থাকেন। পরবর্তী বংশধরেরা নাকালিয়া থেকে ঢাকা জেলার হাসমিলানে চলে আসেন। শাহ আতিকুল্লাহর অধস্তন বংশধর শাহ সৈয়দ খোদাবখশ। তাঁর এক ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ শাহ ও এক মেয়ে সাইয়িদা তালিবুননেছা চৌধুরানী। পাঠানদের পতনের যুগে তুর্কিদের জমিদারি ছিল ধনবাড়িতে। এ বংশের উত্তর পুরুষ ছিলেন রাজা আলী খাঁ সাহেব।
বংশাই ও বৈরান নদের মাঝখানে অপূর্ব নৈসর্গিক প্রকৃতির মধ্যে এ বাড়ির অবস্থান। চন্দ্রবংশীয় রাজা যশোধর সাবেক পুখুরিয়া (বর্তমান ধনবাড়ি এই পরগনার অন্তর্গত ছিল) শাসক ছিলেন মোগল আমলে। তাঁর সেনাপতি ছিলেন গৌড়ের সুলতানের ওমরাহ ধনুয়ার খাঁ। তিনি কৌশলে রাজ্যটি দখল করে পুত্র ইসপিঞ্জার খাঁকে দিয়েছিলেন।
এই ইসপিঞ্জার খাঁ ও তাঁর ভাই মনোয়ার খাঁ ধনবাড়িতে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদের ভেতরের দেয়ালে কড়ি পাথরের লতাপাতা আঁকা অসংখ্য রঙিন নকশা ও কড়ি পাথরের মোজাইক করা হয়। মসজিদটির দেয়ালের বাইরের অংশেও রয়েছে সিমেন্ট আর কড়ি পাথরের টেরাকোটা নকশা। মসজিদটি প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত। সংস্কারের আগে মসজিদটি ছিল আয়তাকার। তখন এর দৈর্ঘ্য ছিল ৪৫ ফুট ও প্রস্থ ছিল ১৫ ফুট। সংস্কারের পর মসজিদটির আকার পরিবর্তিত হয়।
বর্তমানে এটি একটি বর্গাকৃতির মসজিদ এবং সাধারণ তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকৃতির মোগল মসজিদের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কারের পর মসজিদের প্রাচীনত্ব কিছুটা লোপ পেলেও এর চাকচিক্য ও সৌন্দর্য অনেক বেড়েছে। সুন্দর কারুকার্যময় এ মসজিদের পূর্ব দিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ ছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণে আরও একটি করে মোট পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজদিটির চতুর্দিক থেকে ৪টি প্রবেশপথ এবং ৯টি জানালা, ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ, বড় ১০টি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট সুউচ্চ। মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট।
মসজিদটির ৫ ফুট উচ্চতা ও ৩ ফুট প্রস্থের মিহরাব দেখতে আকর্ষণীয় এবং সুপ্রাচীন।
মসজিদের সংরক্ষিত কক্ষে শোভা পাচ্ছে ১৮টি হাঁড়িবাতি। এগুলোতে নারকেল তেল দিয়ে আলো জ্বালানো হতো। রয়েছে মোগল আমলে ব্যবহৃত তিনটি ঝাড়বাতিও। মসজিদের পাশেই রয়েছে শানবাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান, যেখানে দাফন করা হয়েছে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে। সুপ্রাচীন এ মসজিদে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নামাজ আদায় করেন এখানে। আরেক বিস্ময় হচ্ছে এখানে প্রায় ৯৬ বছর ধরে চলছে ২৪ ঘণ্টা পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত। এ ছাড়া অনেকেই এখানে আসেন মনের আশা পূরণের জন্য মানত করতে।
ছবি: উইকিপিডিয়া