চট্টগ্রামকে বলা হয় বার আউলিয়ার শহর। বহু জ্ঞানী-গুণী-সাধক-সন্ন্যাসীর আগমন ঘটেছে এখানে। আবার দীর্ঘকাল থেকে বহু আমলের উত্থান-পতনের সাক্ষী আমাদের এই চট্টগ্রাম। তাই বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামে পুরাতাত্ত্বিক কিছু স্মৃতিচিহ্ন আজও থেকে গেছে পবিত্র মসজিগুলোর দেয়ালজুড়ে। মোগল আমলে তৈরি এমনই এক স্থাপনা আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ। এটি চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর হালিশহরের চৌধুরীপাড়ায় অবস্থিত। ঐতিহাসিক এই মসজিদ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব। এর মধ্য দিয়ে জানা যাবে এই মসজিদের নির্মাণ ইতিহাস ও সব নেপথ্যকথা।
১৭৯৫ সালে আজগর আলী চৌধুরী নামে স্থানীয় একন ব্যক্তি এই মসজিদ নির্মাণ করেন। আজগর আলী ছিলেন সেই সময়ে এই এলাকার সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের বংশধর। তবে তাঁর বিস্তারিত কোনো পরিচয় মেলেনি। এলাকাবাসীর ইবাদতের সুবিধার্থেই তিনি এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মোগল স্থাপত্য অনুসরণ করে ১০ শতক জমির ওপর এই মসজিদ মূলত নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া এর নকশায় তাজমহলের খানিকটা প্রভাবও লক্ষ করা যায়। কেবল চুন-সুরকি দিয়েই তৈরি করা হয় মসজিদটি।
পোড়ামাটির রঙের এই মসজিদের চারপাশ সাজানো হয়েছে নানা রকম নকশায়। শুধু বাইরের দেয়ালই নয়, ভেতরের দেয়াল ও কাঠামোজুড়ে মোগল স্মৃতিচিহ্ন প্রদর্শন করে যাচ্ছে চোখধাঁধানো নানা রকম নকশা। মসজিদের ছাদে শোভা পেয়েছে বড় তিনটি গম্বুজ ও ২৪টি মিনার। এর মধ্যে মাঝখানের গম্বুজটি আকারে বেশ বড়। অবাক করা বিষয় হলো, বিশেষ কোনো জানালা নেই মসজিদটিতে। দরজার আকারও খুব একটা বড় নয়। দেখতে বেশ ছিমছাম।
মসজিদটির সামনে আছে বিশাল এক পুকুর, যা প্রায় ১০০ শতক জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। মসজিদের দক্ষিণে ২০ শতক জায়গায় আছে কবরস্থান। উত্তরে ২৬ শতক জায়গার ওপর আছে চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত উত্তর হালিশহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
আড়াই শ বছরের পুরোনো মোগল আমলে তৈরি এ মসজিদ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে ২০১০ সালের দিকে। এলাকাবাসীর আগ্রহে পুরাতাত্ত্বিক এই নিদর্শন না ভেঙে পেছনে ৭০ শতক জায়গার ওপর সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি মসজিদ নির্মাণ করছেন চৌধুরী পরিবারের বংশধরেরা।
আর আজগর আলী মসজিদটিকে সংস্কার করে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে খরচ হয় ৫০ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে সংস্কার কাজটি করে ঢাকার প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান আরবানা আর্কিটেক্ট। সংস্কার করায় ঐতিহাসিক এই মসজিদটির আয়ু যেন আরও বহুকাল সুদীর্ঘ হলো। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে আরও দীর্ঘ সময় ধরে মোগল স্থাপত্যের স্মৃতি হয়ে থাকবে।
নতুন মসজিদের নকশাও নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের। নতুন মসজিদটি বানানো হয়েছে অনেকটা সংসদ ভবনের আদলে। মসজিদটির তিন পাশেই রাখা হয়েছে জলাধার। ওপর থেকে মনে হবে পানির ওপরই ভেসে আছে যেন মসজিদটি।
অতীত ও বর্তমানের সংমিশ্রণে একাকার এ মসজিদ প্রাঙ্গণে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি জার্মানি, ফ্রান্স ও আমেরিকা থেকেও দর্শনার্থী আসার মতো সুখবরও শোনা গেছে।
চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ থেকে সোজা পশ্চিমে তিন কিলোমিটার গেলেই হালিশহরের বড়পোল। সেখান থেকে আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে এগোলেই চৌধুরীপাড়া। সেখানে গেলেই দেখা পাবেন অনন্যসুন্দর এই নিদর্শনের।
ঐতিহাসিক যেকোনো স্থাপত্যই আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় সুদূর অতীতের তাৎপর্যপূর্ণ কোনো না কোনো ইতিহাসের সঙ্গে। সে ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য রাখতে এ ধরনের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংস্কার করা বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাস সঞ্চারিত হবে অবিচ্ছিন্নভাবে।