ঢাকার মাদানী অ্যাভিনিউ (প্রচলিত ১০০ ফুট রাস্তা ধরে) সাতারকুলে মেয়ের স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে দেখেছি একটি মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইউনাইটেড সিটিতে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পথে হাতের ডান দিকে পড়ে এটা। কয়েক বছরের মধ্যে এ নয়নাভিরাম মসজিদটি গড়ে উঠেছে—মসজিদ আল মুস্তফা। বিশ্বনবীর নামে নাম।
ভাটারা থানা থেকে কিছুদূর এগোলেই আপনি প্রথমে এর মিনারটি দেখতে পাবেন। তারপর এর সোনালি গম্বুজসহ সমগ্র মসজিদটি আপনার চোখের সামনে ফুটে উঠবে। দিনের বেশির ভাগ সময়ে আমি আসা–যাওয়া করি, তাই বলতে পারি একেক সময়ে এটি একেক সৌন্দর্য নিয়ে আপনার দৃষ্টিতে ভেসে উঠবে। প্রায়ই ভেবেছি, একদিন সেখানে নামাজ পড়ার সুযোগ হবে। শেষমেশ সপ্তাহখানেক আগে আসরের ওয়াক্তে মসজিদ আল মুস্তফা নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হলো।
পূর্ব দিকের বিশাল এন্ট্রি দিয়ে ঢুকলে বড়সড় বারান্দা, সেটি পেরিয়ে মূল নামাজঘরে ঢুকলাম। খেয়াল করলাম কিছুদূর পরেই আরেকটি কাচের দেয়াল। প্রথম কক্ষটি বেশ বড়। কাতার গুনে দেখলাম, প্রতি কাতারে ৮০ জন করে ২০ কাতারে প্রায় ১ হাজার ৬০০ জন মুসল্লি এখানে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারবেন। এই অংশটুকু পেরিয়ে আরেকটি কক্ষে এসে পড়লাম। এটি প্রথমটির চেয়ে আকারে ছোট। আমার হিসাবে ৬০০ জন এখানে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারবেন। এখানেই প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার ব্যবস্থা। বর্গাকার এই কক্ষটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ৬৫ ফুট।
প্রথমেই যে বিষয়টি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেটি হলো, এর ভেতরে কোনো কলাম নেই। ফলে সবাই যেমন সবাইকে দেখতে পান, তেমনি মিম্বরে দাঁড়ালে ইমাম সাহেবকে সবাই দেখতে পান।
কলাম নেই বলে আমি সরাসরি সামনের দিকের কাতারের সমান্তরালে বেশ কিছু সুন্দর সোফা বা বসার জায়গা দেখতে পেলাম। অনেক মুসল্লি বসে নামাজ পড়তে চান। তাঁদের জন্য এই ব্যবস্থা। আবার অনেকের বয়সের কারণে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হলে হেলান দিতে হয়। এই সোফাগুলো দুই কাজেই ব্যবহার করা যায়।
উত্তর দিলেন এই মসজিদের স্থাপত্য-নকশাকার ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান স্থপতি ফয়সল মাহবুব। রক্ষণাবেক্ষণ খরচই এর কারণ। মসজিদটি ওয়াক্ফ এস্টেটের আওতায় পরিচালিত হয়। সমগ্র মসজিদকে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আওতায় রাখা হয়েছে। তাই সব ওয়াক্তে সম্পূর্ণটা জুড়ে এসি চালাতে অনেক বিদ্যুৎ খরচ হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মূল ঘরটিকে আলাদা ও ছোট রাখা হয়েছে।
মূল নামাজঘরে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে ছাদের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা। এই ভয়েডের কারণে ওপরের তিনতলার সঙ্গে মূল নামাজঘরের একটা সরাসরি যুক্ততা তৈরি হয়েছে। জুমার নামাজ বা ঈদের নামাজ বা যেকোনো বড় জামাতের সময় সব ফ্লোরের মুসল্লিরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন। আবার মিম্বরের ওপরের অংশটুকু কাচের হওয়ায় সব ফ্লোর থেকেই খুতবা প্রদানরত ইমাম সাহেবকে দেখা যায়।
সাধারণ মসজিদের তুলনায় এর ছাদগুলো যথেষ্ট উঁচু। প্রথম তলাটি প্রায় ১৮ ফুট উঁচু। অন্য তলাগুলো ১৫ ফুট। ‘আমরা অনেকেই ভাবি, আল্লাহ তাআলার রহমত ওপর থেকে নেমে আসে।’ তাই এই খোলা জায়গাটা রাখা হয়েছে। জানালেন স্থপতি মাহবুব।
ভালো কথা, ঢোকার সময়ে বেশ কিছু বিষয় লক্ষ করেছি। প্রথমটি হলো সোনালি গম্বুজ। আমাদের দেশে সোনালি গম্বুজ খুব একটা দেখা যায় না। সোনালি গম্বুজের মসজিদ হলো মসজিদ আল আকসা। ‘সেখান থেকেই গম্বুজের রংটা আমরা নিয়েছি।’ স্থপতি আরও জানালেন, মসজিদ প্রকল্পের শুরুতে তাঁরা ইসলামের তিনটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদকে এই মসজিদে ধারণ করতে চেয়েছেন। মসজিদের চারপাশের দেয়ালের অফ হোয়াইট রংটি নেওয়া হয়েছে মদিনার মসজিদে নববি থেকে। আর ঢোকার মুখের অংশ এবং ইমামের সামনের অংশটুকু পবিত্র কাবা শরিফের অনুপ্রেরণায় কালো রং করা হয়েছে। আর এভাবে মসজিদ আল মুস্তফা ধারণ করেছে ইসলামের প্রধান তিনটি মসজিদকে। এই মনোরম মসজিদের কাঠামো-নকশা করেছেন ইউনাইটেড গ্রুপের প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
তা নয়। জানা গেল এই মসজিদের বিভিন্ন উপকরণ জোগাড় করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে। এমনকি বড় মাপের (৩২ ইঞ্চি X ৩২ ইঞ্চি) টাইলসগুলো আলাদাভাবে ডিজাইন করে বানানো হয়েছে স্থানীয় কারখানায়। ব্যবহার করা হয়েছে দেশীয় কাঠ। সেটা ছাড়াও স্থপতি ফয়সল মাহবুব আমাকে গম্বুজের আকার ও ধরনটি লক্ষ করতে বললেন। জানালেন, ‘এর গম্বুজের ডিজাইনটা নেওয়া হয়েছে তাজমহলের গম্বুজের ডিজাইন থেকে, যাতে উপমহাদেশের স্থাপত্য ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারি।’ ৭০ ফুট ব্যাসের গম্বুজের কারণে মূল কক্ষটিকে কলামমুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছে।
নামাজ পড়ার সময় শব্দের ব্যাপারটি লক্ষ করেছি। খুবই স্পস্টভাবে ইমামের কিরাত শোনা যায়। বোঝা যায়, সাউন্ড সিস্টেমের জন্য আলাদাভাবে নজর দেওয়া হয়েছে। জানা গেল, বিশ্বখ্যাত সাউন্ড সিস্টেম প্রতিষ্ঠান বোস ও নয়েজ সাউন্ডের কর্মীরা মসজিদের সাউন্ড সিস্টেম ডিজাইন ও বাস্তবায়ন করেছেন। ফলে যেকোনো অবস্থান থেকে প্রাঞ্জলভাবেই কিরাত শোনা যায়।
নামাজ শেষে মূল নামাজঘর ও এর সম্প্রসারণ থেকে বের হয়ে পুরো মসজিদটি ঘুরে দেখলাম। ওপরের ফ্লোরে যাওয়ার জন্য উভয় পাশে সিঁড়ি ছাড়াও রয়েছে এসকেলেটর। আবার লিফটও আছে। ফলে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তিরা সহজে ওপরের ফ্লোরগুলোতে যেতে পারেন। ওপরের তিনটি ফ্লোরে সম্প্রসারিত কক্ষ মূল কক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত। এর কারণ হলো, শুক্রবার বা ঈদের জামাতে সব ফ্লোরে মুসল্লিরা থাকেন। বাইরের খোলা জায়গাসহ সিঁড়ির সামনের ঘর মিলিয়ে আরও প্রায় ৪০০-এর মতো মুসল্লির স্থান সংকুলান সম্ভব। তাই সব মিলিয়ে এতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন।
বেজমেন্টে রয়েছে অজু করার ব্যবস্থা। মসজিদের আয়তন অনুসারে বেশ বড়সড় অজুর স্থান রয়েছে। তবে বয়স্ক ব্যক্তিদের অপেক্ষার সময়ে বসার জায়গা থাকতে পারত। বেজমেন্টেই রয়েছে মেয়েদের জন্য পৃথক নামাজের জায়গা। সেখানে প্রায় এক হাজার নারী একত্রে নামাজ পড়তে পারেন। ফলে মসজিদের মোট ধারণক্ষমতা হলো ১১ হাজার!!! মুসল্লি ধারণক্ষমতার বিচারে এটি দেশের বড় মসজিদগুলোর অন্যতম।
বেজমেন্টে আরও রয়েছে পার্কিং। ১০০টির বেশি গাড়ি সেখানে রাখা যায়।
মসজিদের দক্ষিণ দিকে একটি চন্দ্রাকৃতির কৃত্রিম লেক তৈরি করা হয়েছে। আমি অবশ্য পানি দেখিনি। জানা গেল, বালুর কারণে পানি ধরে রাখা সম্ভব হয় না। নতুন করে এর মেঝে নির্মাণ করা হচ্ছে। এই লেকের পাড় ঘেঁষে হাঁটার ও বসার জায়গা করা হয়েছে। ইসলামে মসজিদ শুধু নামাজের জন্য নয়। বরং এটি মুসলিমদের জমায়েতের একটি স্থান। মসজিদকে কেন্দ্র করে নানা বয়সী মানুষের একত্র হওয়াটাও একটা উদ্দেশ্য। আর লেকের পাড় নামাজ শেষে মুসল্লিদের জন্য জিরিয়ে নেওয়া বা আলোচনার একটি মনোরম স্থান।
মসজিদ আল মুস্তফার আরেকটি সৌন্দর্য হলো এর বাতির ব্যবহার। প্রতিটি অংশের ঝাড়বাতি ও অন্য বাতিগুলোকে বিশেষভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। প্রতি শুক্রবার মাগরিবের পর থেকে এশার নামাজ পর্যন্ত সব বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হলে মসজিদের রাত্রিকালীন আভিজাত্য ফুট ওঠে। তখন দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটি আলোর দ্বীপ!
নামাজ শেষে মসজিদ দেখে চলে আসার সময় খেয়াল করলাম মিনারের ওপরের অংশের গম্বুজ। প্রথম দেখায় এটিকে অসম্পূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু এটিই ডিজাইন। স্থপতি মাহবুব জানালেন, ইসলামের দর্শনকে ধারণ করেই এটি করা হয়েছে।
আপনি যদি ইসলামের রীতিনীতি মনে চলেন তাহলে আপনার জীবন হবে সোনালি গম্বুজের মতো সুন্দর; কিন্তু আপনি যদি তা না হোন তাহলে আপনি হবেন ‘বডি উইদাউট এ সোল’।