নাগরিক ঋতুগুলো বড়ই ক্ষণস্থায়ী ও এলোমেলো। শীত গিয়ে বসন্ত এল। এরপর গ্রীষ্ম না আসতেই বর্ষার ঘনঘটা। তবে আবহাওয়া কেমন তা আলাদা করে ভাবার সময় খুব কমই মেলে এই ব্যস্ত শহরে। বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকি। ফোনে গান শুনতে থাকি। বড় বড় ইমারত, দালান আর মানুষের মুখ ছাড়া এ শহরে দেখার মতো তেমন কিছু পাই না।
কিন্তু পড়ন্ত বিকেলে কোনো কোনো বাড়ির পর্চ বা ছাদে অথবা আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টগুলোর বারান্দায় হুট করেই চোখ ঝলসে যাওয়ার মত বাগানবিলাস ফুলের দেখা পাই। এটুকু রঙের বিলাস এখনো বেঁচে আছে নগরীর এই বিবর্ণ ল্যান্ডস্কেপে৷ শহুরে বাগানবিলাসীদের বাগান-বিলাস হয়ে টিকে আছে নানা শেড ও রঙের বাগানবিলাস ফুল।
চমৎকার এই ফুলটির আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। নগর বিশ্বায়নের হাত ধরে এই গাছটিরও বিশ্বায়ন ঘটেছে পৃথিবীর উষ্ণ আবহাওয়া যুক্ত এলাকায়। বিশেষত ছায়াযুক্ত পথ তৈরি ও গৃহ শোভা বর্ধনে এর আছে আলাদা কদর। সারাবছর এ গাছে কমবেশি ফুল আসে। তবে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালেই বেশি ছেয়ে যায় এই গাছগুলো ফুলে ফুলে। ট্রাফিক জ্যাম অথবা দূষণের দুর্দশার মাঝেও শহরের মূল রাস্তাগুলোর ডিভাইডারে যখন গাঢ় ম্যাজেন্টা বাগানবিলাস ফুটে থাকতে দেখি, তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনে হয় এ নগরে বুঝি, 'এত ফুল ফোটে, এত পাখি গায়!'
রবীন্দ্রনাথের গানই গুনগুনালাম বাগানবিলাস দেখে। জানা যায়, বাগানবিলাস নামটির সঙ্গেও রবি ঠাকুর জড়িয়ে আছেন। সকালবেলায় ফোটা পর্তুলিকা ফুলের নাম তিনি দিয়েছিলেন পথ চলিকা। ঠিক সেভাবে বোগেনভিলিয়া ফুলের নামও তিনি দিয়েছেন বাগানবিলাস।
নামের মধ্যে বিলাস শব্দটা থাকলেও বাগানবিলাস গাছেরা কিন্তু একেবারেই বিলাসী নয়, বরং তার আছে তীব্র প্রাণশক্তি আর সহিষ্ণুতা ! প্রখর রোদ বা তাপ সবকিছু উপেক্ষা করেও এই গাছ টিকে থাকে এবং ফুল ফোটায়।
কত রঙের বাগানবিলাস দেখতে পাওয়া যায়! ম্যাজেন্টা, হালকা গোলাপি, হলুদ, সাদা, কমলা থেকে শুরু করে গ্রাফটিং ও কাটিং টেকনোলজির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে একই গাছে একই সঙ্গে বিভিন্ন রঙের বাগানবিলাস ফুটতে দেখা যায়। ঢাকার আগারগাঁও, বেগম রোকেয়া সরণী, পরিবাগ এলাকা, দোয়েল চত্বর, বেইলি রোড ও শিশু একাডেমির সামনে বেশ কিছু নার্সারি আছে, যেখানে বাগানবিলাসের বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা কিনতে পাওয়া যায়।
বাগানবিলাসের সমারোহ দেখতে দেখতে আবারো রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যাই।
'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান।'
সে অরণ্যকে ফিরিয়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে চেষ্টা করলে আমাদের প্রত্যেক গৃহকোণে এক টুকরো বাগান গড়ে তোলা সম্ভব। ঘুম থেকে উঠে যখন জানালার পর্দা সরাবেন, অথবা বিকেলবেলায় বারান্দায় যাবেন মেলে দেওয়া কাপড়গুলো ঘরে তুলে আনতে, চোখে পড়বে একগুচ্ছ বাগানবিলাস ঝলমলে আলোর মতো ফুটে আছে।
নিজের হাতে রোপণ করা গাছে যখন ফুল আসে, নতুন পাতা ছড়ায় এই আনন্দ মস্তিষ্কে সেরেটোনিন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সেরেটোনিনকে বলা হয় হ্যাপি হরমোন। গাছ আমাদের মন ভালো রাখে, ফুল আমাদের মনে আনন্দ যোগায়। আর বাগানবিলাস এমন একটি গাছ যা খুব অল্প যত্নেই টিকে থাকে এবং ফুল ফোটায়। সে ফুল আমাদের মন ভালো করে দেয়।
লেখক: সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর (ট্রেইনি)
ছবি: লেখক