ইচ্ছাটা বহুদিনের। মধ্য আগস্টে গিয়েছিলাম, কিন্তু জামগড়ায় যাওয়া হয়নি। এর কিছুদিন পরই শুরু হয়েছে শিখো-প্রথম আলো জিপিএ ৫ কৃতীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। তখনই মনে হলো, ফ্যান্টাসি কিংডমে জিপিএ-৫ সংবর্ধনার আয়োজন হয় দুই দিন, এক দিন আমি থাকবই। তখন চেষ্টা করা যাবে।
২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সকাল সকাল ঢাকা থেকে ফ্যান্টাসি কিংডমের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সহযাত্রী কক্সবাজার থেকে হেঁটে এভারেস্টের চূড়ায় যাওয়া ইকরামুল হাসান শাকিল আর আমাদের স্কাউট ইনামুল। পথে বললাম, ‘দুপুরে জেবুন নেসা মসজিদে নামাজ পড়তে চাই।’ গাড়ির পাইলট গুগল ম্যাপ দেখে আপত্তি জানালেন। ভাবলাম, ঠিক আছে—ফ্যান্টাসিতে গাড়ি রেখে বাংলার টেসলা নিয়ে যাওয়া যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। দুপুরে খেয়ে আমি আর ইনামুল টেসলা নিয়ে বের হলাম। আশপাশের কেউ নাম দিয়ে মসজিদটা চিনল না। ম্যাপের ভরসায় এগোতেই সামনে দেখা দিল এক বিপদ—রাস্তাজুড়ে নদীর মতো পানি! বৃষ্টির সঙ্গে কারখানার নীল রঙের কেমিক্যাল মিশে তৈরি হয়েছে একেবারে ‘নীল নদ’। টেসলা ড্রাইভারের ভরসায় কিছু দূর যেতেই ভয় পেলাম। টেসলা যদি গর্তে পড়ে? সামনের গাড়িগুলোতেও পানি পাদানি পর্যন্ত উঠে গেছে। ভয়ে ঘুরে আবার ফ্যান্টাসি কিংডমে ফিরে এলাম। ওখানেই জোহরের নামাজ পড়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে, আমার আর শাকিলের মঞ্চে ওঠার ঠিক আগে ইনামুল এসে বলল, ‘স্যার, আমি মসজিদটা দেখে এসেছি। আপনি যেতে পারবেন।’ তার কাছ থেকে জানলাম, ওই পানি পার হলেই একটি কারখানার ভেতরে কাঙ্ক্ষিত মসজিদ।
নিজের পর্ব শেষ করে আবার রওনা হলাম। ইনামুল আগেই অনুমতি নিয়ে রেজিস্টারে নাম লিখে রেখেছে। কাজেই সহজেই কারখানার ভেতরে ঢুকলাম। প্রথমে চোখে পড়ল লতাগুল্মে ছাওয়া কারখানা ভবন—রংপুরের কারুপণ্য কারখানার মতো। কিছুটা এগিয়ে সীমানার পাশে যেতেই হঠাৎই চোখের সামনে ফুটে উঠল গোলাপি রঙের মসজিদ। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমার এ ইচ্ছা পূরণ করলেন।
বছরখানেক আগে আর্চ ডেইলিতে এই মসজিদের ফিচার দেখে আগ্রহ জেগেছিল। দুটো বিশেষ কারণ—প্রথমত, জেবুন নেসা আমার মায়েরও নাম। দ্বিতীয়ত, এর স্থপতি একজন নারী। আমাদের দেশে নারী স্থপতিরা যে মসজিদ ডিজাইন করেছেন বা করছেন, সেখানে নতুনত্ব খুঁজে পাই। এখানেও নিশ্চয়ই আছে।
টেসলা থেকে নেমে মসজিদের দিকে হাঁটলাম। দূর থেকে দেখা গেল উন্মুক্ত টেরাস আর বাঁকানো কাঠামো। একটা ঝুলন্ত দেয়াল, যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। গোলাপি ইটের র্যাম্প আর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। খোলা প্রাঙ্গণে দুজনকে গল্প করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, অজুখানা কোথায়। জুতা খুলে হাতে নিতেই তাঁরা হেসে বললেন, ‘ভয় নেই, কেউ নেবে না।’ লজ্জা পেলাম। তারপর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গেলাম। পথে বাঁকা সিঁড়ি, ছাতিমগাছের ছায়া মেখে দোতলায় উঠে গেছে। আমি পাশ কাটিয়ে অজুখানায় গেলাম।
চমকে উঠলাম, গোলাপি মেঝে আর দেয়াল সেখানে রূপ নিয়েছে ফিরোজা রঙে। দিগন্তে দেখা যাচ্ছে অবারিত পানিরাশি। পশ্চিমে হেঁটে গেলাম, দেখলাম, মসজিদের সীমানার পরেই বড় পুকুর—বর্ষার জলে ভরে এখন লেকের মতো। পুকুরের সঙ্গে মিল রেখে পশ্চিম আঙিনায় ছোট্ট অগভীর সরোবর বানানো হয়েছে। আমি যখন সেখানে, সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে—আসরের ওয়াক্তের নরম আলোয় জায়গাটা প্রশান্ত। অজুখানায় ইটের ভাঙা টুকরা যত্ন করে বসানো, সেটাও আলাদা সৌন্দর্য দিয়েছে। এই মসজিদের স্থপতি সায়কা ইকবাল মেঘনা। তিনি জানান, এর উদ্দেশ্য কর্মীদের জন্য শান্তির ছায়াঘেরা স্থান তৈরি করা। পানির সঙ্গে সংযোগের কারণে অজুখানায় অনেকে বসে গল্প করেন।
বর্তমানে এই মসজিদের স্থাপত্য নিয়ে দেশ-বিদেশে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সায়কা ইকবাল মেঘনা বলেন, ‘বিশ্বের নানা দেশ থেকে স্থপতি ও একাডেমিশিয়ানরা এটি দেখতে আসেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ভারত, মিসর, তুরস্ক, উজবেকিস্তান, আরব আমিরাত ও ফিলিস্তিনের স্থপতিরা ঘুরে গেছেন। তাঁদের মধ্যে মিসরীয় স্থপতি দেখতে এসে অজুর আসনে বসে অনেক সময় কাটিয়ে গিয়েছেন।’
অজু শেষে পূর্ব দিকের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই বিস্মিত হলাম, নামাজঘরটি বৃত্তাকার! পুরো কাঠামো একটি বর্গের ভেতরে একটি বৃত্ত। বৃত্তাকার নামাজঘর আমার এই প্রথম দেখা। সায়কা বললেন, ‘বৃত্ত হলো অমনি–ডিরেকশনাল আকার, শুরুও নেই শেষও নেই—অনন্তের প্রতীক।’ বৃত্তাকার অংশটির ওপরেই ভাসছে গম্বুজ। মাঝে কোনো পিলার নেই। যে জায়গায় দাঁড়িয়েই নামাজ পড়ুন, ইমামকে দেখতে পাবেন।
সবচেয়ে বিস্মিত হলাম কিবলার দিক প্রকাশক মিহরাব দেখে। প্রচলিত মসজিদের মতো এখানে শক্ত দেয়াল নেই। বরং পশ্চিমমুখী বাঁকানো দেয়ালের প্রশস্ত খিলান আর প্রতিফলিত জলাধার মিলিয়ে কিবলার দিকনির্দেশক, যা বিদ্যমান পুকুরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জায়গাটিকে আলোকভরা অসীমতার দিকে নিয়ে গেছে। ভেতরে বসে মনে হলো, আমি অসীমের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছি। সামনে ফিরোজা রঙের কাচের মিহরাব—দেয়াল অথচ দেয়াল নয়।
কাচের এই মিহরাব ডিজাইন ও নির্মাণ করেছেন প্রখ্যাত শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। তাঁর কাছে জানলাম, তিনি এমন একটা কিছু করতে চেয়েছেন, যা দেয়ালের মতো, তবে দেয়ালের মতো দৃষ্টি আটকে ফেলবে, এমন নয়। মুসল্লিরা কিবলার দিকটা খুঁজে পাবেন, আবার সেটা ছাপিয়ে একই সঙ্গে অসীমেও মিলতে পারবেন। আমাদের স্থানীয় আট মিলিমিটার পুরুত্বের কাচের টুকরা পরপর সাজিয়ে নিয়ে একটার ওপর একটা বসিয়ে এটা নির্মাণ করা হয়েছে। কাচ বেশ ওজনদার বলে সেটাকে খাড়া রাখার জন্য কিছু কারিগরি কাজও করতে হয়েছে। কাছে গিয়ে টের পেয়েছি ভেতরের পানির সরোবর থেকে এটি ওপরে উঠে এসেছে। এর একদম ওপরে ‘আল্লাহু’ কথাটি খোদাই করা আছে। মসজিদের ভেতর থেকে দেখলে মনে হবে, পানির ওপর এটি ভেসে আছে!
ভেসে থাকার অনুভূতি আরও আছে। পাতলা শেল গম্বুজ ছিদ্রযুক্ত বাঁকানো দেয়ালের ওপর ভাসছে কোনো পিলার ছাড়া। এটি সম্ভব হয়েছে স্থপতি ও কাঠামো প্রকৌশলী শামসুল আলমের যৌথ সৃষ্টিতে।
আমি বুঝলাম, এটি ডাবল-ওয়াল মসজিদ। বর্গাকার কাঠামোর ভেতরে বৃত্তাকার অংশ, চারপাশে চারটি আলো-আঙিনা। বাইরের দেয়াল পূর্ব-পশ্চিমে নরম বাঁক নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। উত্তর-পূর্বের ঝুলন্ত কোণটাই মূল প্রবেশপথ, যা হয়ে উঠেছে এই মসজিদের প্রতীকী ছবি। দুই দেয়ালই জালির মতো ছিদ্রযুক্ত, আলো-বাতাস চলাচল করছে অনায়াসে। ভেতরে এসেই টের পেলাম—বাইরের তুলনায় শীতল। দরজা-জানালা ছিদ্রযুক্ত ধাতব পাত দিয়ে তৈরি। ফলে বর্ষাকালের বাতাসও ছেঁকে আসে। কোনো এয়ারকন্ডিশনার নেই, কয়েকটা ফ্যান আছে। অথচ ভেতরটা শীতল ও প্রশান্ত, একেবারে ব্রেথিং প্যাভিলিয়ন।
ভেতরের পূর্ব দিকে এক-তৃতীয়াংশ জায়গা দোতলা, যা মহিলাদের নামাজ ও সমবেত হওয়ার জন্য। দক্ষিণ-পূর্ব প্রাঙ্গণে ছিদ্রযুক্ত ধাতব সিঁড়ি দিয়ে সেখানে ওঠা যায়। পাশে ছাতিমগাছ, শিমুল, কাঞ্চনসহ ল্যান্ডস্কেপ ভাবনাচিন্তা করেই সাজানো গাছপালা।
ইসলামের মসজিদ শুধু নামাজের জায়গা নয়, সম্প্রদায়ের মিলনস্থলও। এখানেও তা–ই। ভেতরের চেয়ে বাইরের খোলা জায়গা বড়। অনেকেই খোলা আঙিনায় নামাজ পড়ে চলে যান। ফেরার সময় দেখলাম, কারখানার কর্মীরাও নামাজে আসছেন।
কারখানার মালিক তাঁর মায়ের নামে মসজিদটি করেছেন মূলত ৬ হাজার ৫০০ কর্মীর জন্য, যেন তাঁরা সময় পেলে এখানে নামাজ পড়তে পারেন বা বসে থেকে নিজেকে অসীমের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন। স্থপতি সায়কা ইকবাল মেঘনা বলেন, ‘পশ্চিম দিকের পানিটা যেন দেখা যায়, সেভাবেই নকশা করা হয়েছে। চারপাশের আবদ্ধ জায়গায় ছোট সরোবর রাখা হয়েছে, যাতে পানিই হয়ে ওঠে প্রশান্তির উৎস।’
ফেরার সময় মনে হলো এটি কেবল একটি মসজিদ নয়, বরং শান্তি, প্রকৃতি আর স্থাপত্যের এক অনন্য মিলনস্থল। এখানে নামাজ পড়তে বসলে মনে হয়, আপনি শুধু স্রষ্টার সঙ্গে নয়, অসীমের সঙ্গেও সংযুক্ত হয়ে গেলেন।
ছবি: স্থপতি সায়কা ইকবাল মেঘনার সৌজন্যে প্রাপ্ত