এই ৬টি উপকারিতা জানলে শুধু পয়লা বৈশাখে নয়, বছর জুড়েই আপনি কাঁসা-পিতলের তৈজস ব্যবহার করবেন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখ বরণে কাঁসার থালা-বাটি ও পিতলের নানান সামগ্রীর কদর আছে বেশ। আগেও ছিল। যেকোনো উৎসবের আগে তেঁতুল দিয়ে এগুলো মেজে ঝকঝকে করা হতো। তবে আজকাল বিভিন্ন কারণে একেবারেই কমে এসেছে এই অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর তৈজসের প্রচলন।প্রাচীন ইতিহাসের ধারায় কাঁসা পিতলের বাসন-কোসন সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল। বাঙালীর ঐতিহ্যের এই কাঁসা আর পিতলের কদর আজ আর তেমন না থাকলেও তবু এ শিল্প টিকে আছে সৌখিন মানুষের সংগ্রহ, বংশানুক্রমিক ব্যবসা আর বিভিন্ন ব্র্যান্ড শপ ও অনলাইন উদ্যোক্তাদের প্রয়াসে।

কাঁসার থাকা বাটিতে পরিবেশিত বাঙালি খাবার
কাঁসার থাকা বাটিতে পরিবেশিত বাঙালি খাবার

শাঁখারীবাজারের কাঁসাশিল্পী নবীন চন্দ্র দাসের বয়ানে, আজও অনেকে কাঁসার সামগ্রী ব্যবহার করেন। তবে আগের মতো নয়। দাম একটু বেশি বলেই হয়তো। তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, প্রতি কেজি কাঁসার সামগ্রী কত দামে বিক্রি হয়৷ গ্লাস কেনা যাবে ১ হাজার ৮শ' টাকা কেজি দরে। থালা ১ হাজার ৫শত  টাকা কেজি। সাধারণত অগ্রহায়ণ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত সনাতন ধর্মের বিয়েতে কাঁসার সামগ্রী বেশি বিক্রি হয়।

বিজ্ঞাপন

একসময় আমাদের দেশে তামা, কাঁসা ও পিতলের জিনিসপত্র ব্যবহারের খুব প্রচলন ছিল। বিশেষ করে তৈজসপত্র ও নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাস, ইত্যাদি দেখা যেত ঘরে ঘরে। অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এখনও কাঁসার থালায় খাবার পরিবেশন আতিথেয়তার একটা অংশ মনে করেন। একসময় বনেদি ও বড় গেরস্থ ঘরে প্রত্যেকের খাবার জন্য আলাদা করে কাঁসার থালা ছিল।

আগে এমন কাঁসার থাকায় ভাত খাওয়া হতো
আগে এমন কাঁসার থাকায় ভাত খাওয়া হতো
নকশা করা পিতলের জিনিস উপহার দেওয়া হতো
নকশা করা পিতলের জিনিস উপহার দেওয়া হতো

কাঁসা-পিতলের এসব সামগ্রীর কোনো কোনোটির ওপর থাকত বাহারি নকশা। কেউ নাম লিখিয়ে নিতেন অনেকেই। আগের দিনের বিয়ের নিমন্ত্রনে কাঁসা আর পিতলের জিনিসপত্র উপহার দেওয়ার রেওয়াজ ছিলো। শিল্পের মর্যাদায় এই দুই ধাতুর তৈজসপত্র ছিল বেশ ওপরে।কাঁসা-পিতলের কারিগরদেরও ছিল নামডাক। কে কত নিখুঁত ও ঝকঝকে বাসন বানাতে পারেন তার প্রতিযোগিতা হতো। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, কয়েক হাজার বছর আগে কয়েক সভ্যতা জুড়ে আছে এই কাঁসা ও পিতলের শিল্প। প্রত্নতত্ববিদরা দেশের বিভিন্ন স্থানে খনন করে কাঁসার সামগ্রী পেয়েছেন। টাঙ্গাইল ও ঢাকার ধামরাই ছিল এই শিল্পের সূতিকাগার। কাঁসা ও পিতলের সামগ্রী পাঠানো হতো বিদেশে। সুন্দর কারুকাজ, নান্দনিক ও গুণগত মানে কাঁসার জিনিসপত্র দেখে মুগ্ধ হয় ব্রিটিশরা। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজরা কাঁসা শিল্পীদের প্রশংসা করে পুরস্কার ও পদক দিয়েছিলো ।যাঁরা পুরস্কৃত হয়েছিলেন তাদের বংশধরের অনেকে টাঙ্গাইলের কাগমারী, মগড়া, সাকরাইল গ্রামে কাঁসা শিল্পের অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন৷ অনেকে ভারতে চলে গেছেন। কেউ কেউ পেশা বদলেছেন। ইতিহাস বলে, রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলে উপমহাদেশে ভারতের কংস বণিকদের মাধ্যমে এই দেশে কাঁসা শিল্পের প্রচলন ঘটে। সেই হিসেবে কংস বণিকরাই কাঁসা শিল্পের উদ্ভাবক বলে জানা যায়।

বিজ্ঞাপন

শাঁখারীবাজারের কাঁসা ব্যবসায়ী অভিমান্য বণিক জানান, তামা, পিতল ও কাঁসার জিনিসপত্রের মধ্যে কাস্তেশ্বরী, রাজভোগী, রাঁধাকান্তি, বংগী, বেতমুড়ি, রাজেশ্বরী, রত্নবিলাস, ঘুটা ও কলতুলা নামে রয়েছে থালা ও গ্লাস। কৃষ্ণচুড়া, ময়ুরকণ্ঠী,ময়ুর আঁধার, মল্লিকা ইত্যাদি নামে পাওয়া যায় জগ। রাজভোগী, জলতরঙ্গ, রামভোগী, গোলবাটি, কাজল বাটি, ঝিনাই বাটি, ফুলতুলি বাটি নামে আছে বাটি। বোয়াল মুখী, চন্দ্রমুখী, চাপিলামুখী, পঞ্চমুখী, ঝিনাইমুখী নামে আছে চামচ। এছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুই তামা, কাঁসা ও পিতলের পাওয়া যায়। পূজা-অর্চনায় পিতলের মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গলঘট ইত্যাদি আর কাঁসার বাদ্যযন্ত্র উল্লেখযোগ্য।

পিতলের মগ ও কাঁসার প্লেটের দাম বেড়েছে অনেক
পিতলের মগ ও কাঁসার প্লেটের দাম বেড়েছে অনেক

নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর ধরন বদলে যাওয়ায় বর্তমানে এ শিল্পে বাস্তবিকই ধ্বস নেমেছে। গত ১৫ বছরে কাঁসা-পিতলের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। এক কথায় ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছে না তামা, কাঁসা, পিতলের শিল্প, বললেন অনলাইন ভিত্তিক প্লাটফর্ম বি-বাসিনীর স্বত্বাধিকারী শিউলি আক্তার।'কাঁসা শিল্পীরা এখন থালা,বাটি, কলসি বানান না। প্রদীপ, মোমদানি, চিলমচি, সৌন্দর্যবর্ধক হোম ডেকোর আইটেমকেউ কেউ বানিয়ে নেন। আমরা যেমন অর্ডার করে বানিয়ে নিয়ে আসি'। শিল্পীদের ভাষ্যে, কাঁসার জিনিস বানিয়ে তেমন লাভ নেই। বেশি দরে কাঁচামাল কিনে জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে কতই বা লাভ হয়! কাঁসা গলিয়ে ঢালাই প্রযুক্তির মাধ্যমে জিনিস বানাতে হয়। দরকার হয় বিশেষ ধরনের ছাঁচের। এগুলো এখন সহজে পাওয়া যায়না। কাঁসার ভাস্কর্য তৈরির পদ্ধতিও আলাদা। মোম দিয়ে অবয়ব তৈরির পর নকশা ও সূক্ষ্ম কারুকাজ করে দিতে হয় তিন স্তরের মাটির প্রলেপ। তারপর পুড়িয়ে মোম গলে মাটির ছাঁচে লেগে যায়। গলানো কাঁসা সেই ছাঁচে ঢুকিয়ে তৈরি হয় নকশা ও ভাস্কর্য। ঐতিহ্য ধরে রাখতে শৌখিন লোকজনই কাঁসা কেনেন। এভাবেই যত দিন টিকে থাকে।

পুরান ঢাকার অধিবাসী শিশির চৌধুরী জানান, পৈতৃক পেশাকে ধরে রাখার জন্য বর্তমানে শাঁখারি বাজার, ইসলামপুর ও মিটফোর্ড এলাকায় প্রায় ১০-১৫টি পরিবার আজও কাঁসাশিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে। শাঁখারি বাজারে পিতলের থালা-বাসন কিনতে আসা অনন্যা রানি নামের এক ক্রেতা বলেন, 'অনেকেই এই তামা, কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র ব্যবহারের  উপকারিতা সম্পর্কে জানে না। তাই সবাই অল্প দামের প্লাস্টিক আর ম্যালামাইনের দিকে ঝুঁকেছে। সবাই যদি কাঁসা পিতলের উপকারিতা সম্পর্কে জানতো তাহলে এটার মূল্য বেশি হলেও কিনত'।

শিশুদের কাঁসার তৈজসে খাবার খাওয়ালে উপকার মেলে
শিশুদের কাঁসার তৈজসে খাবার খাওয়ালে উপকার মেলে

কাঁসা ও পিতলের পাত্রে খাওয়ার কিছু গবেষণালব্ধ ফল জেনে নিন এবার।

কাঁস আর পিতলের পাত্রে রাখা খাবার খেলে পাকস্থলীতে থাকা বেশ কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়।

প্রতিদিন কাঁসা-পিতলের গ্লাসে পানি পান করলে শরীরের দূষিত পদার্থ বেরিয়ে যায়। লিভার ও কিডনির কর্মক্ষমতা বাড়াতেও দারুণ কাজে আসে ধাতুটি।

রাতে কাঁসার গ্লাসে পানি রেখে পরদিন সকালে পান করুন। নিয়মিত এভাবে পানি পান করলে শরীরে তামা বা কপারের মাত্রা বাড়তে শুরু করে।এতে একদিকে যেমন শরীরের কোষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে আয়রনের শোষণ হারও বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে।

কাঁসা-পিতলের সামগ্রী ব্যবহার করা অনেক স্বাস্থ্যকর
কাঁসা-পিতলের সামগ্রী ব্যবহার করা অনেক স্বাস্থ্যকর

আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কাঁসা ও পিতলের পাত্রে খাবার খেলে হার্ট অ্যাটাক, কোলেস্টরল এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের ঝুঁকি কমে।  

শরীরে তামার ঘাটতি দূর করতে সাহায্য করে কাঁসা। ফলে মস্তিষ্কে থাকা নিউরনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও স্মৃতিশক্তি বাড়ে।

কাঁসায় থাকা তামা পানিতে লুকিয়ে থাকা ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে। তাই নিয়মিত কাঁসার পাত্রে পানি পান করলে ছোট-বড় নানা ধরনের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

চলুন আমরা নতুন বছরে ঐতিহ্যের পুনরুত্থান ঘটাই। নতুন করে শুরু করি কাঁসা-পিতলের তৈজসের প্রচলন। ঐতিহ্যবাহী এই তৈজসপত্র শুধু পয়লা বৈশাখে নয়, সারা বছর থাকুক আমাদের জীবনে জড়িয়ে। সেই আগের দিনের মতো।

তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া

ছবি: বি বাসিনী

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৭: ১৪
বিজ্ঞাপন