বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘ভূতের ভয়’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আজকের দিনের সব সত্য আর অঙ্ক, যা হচ্ছে গিয়ে ফ্যাক্টস, খবরের কাগজের সত্য যখন ধুলো হয়ে হারিয়ে যাবে হাওয়ায়, তখনো ভূত থাকবে। ভূত থাকবে, মানুষ থাকবে যত দিন। কে বলে ভূত নেই? ভূত যে আছে আমাদের মনের মধ্যে, আমরাই তাকে সৃষ্টি করেছি মনের ইচ্ছা থেকে। ভূত আমরা চাই।’
পৃথিবীর নানা দেশে ভূতদের আবির্ভাব হয়েছে সেই দেশের যাপন আর লোকসংস্কৃতি অনুযায়ী। বিভিন্ন দেশের ভূতের নাম ভিন্ন, আকৃতিও আলাদা। রোমানিয়ায় যেমন সামকা, ব্রাজিলে তেমন পিসাডেইরা। আবার জাপানে ওনরোয়ো, স্পেনে সান্টা কম্পানা, ফিলিপাইনে মানামাঙ্গাল, ইসরায়েলে ডাইবুক, চীনে জিয়াংশি, আয়ারল্যান্ডে বানশি, মরক্কোয় আইচা কান্ডিচা, শ্রীলঙ্কায় মোহিত, ইন্দোনেশিয়ায় কুন্তোলিকা, সৌদি আরবে ইফ্রিত, ভেনেজুয়েলায় লা সাইওনা, দক্ষিণ কোরিয়ায় গিউসিন, নেপালে ইয়েতি, গ্রিসে শেইড, রাশিয়ায় চর্ট, থাইল্যান্ডে মায়ে নাক, যুক্তরাজ্যে ব্লাডি ম্যারি, মালয়েশিয়ায় পেনাঙ্গালান, যুক্তরাষ্ট্রে বেল উইচ/অ্যানাবেল, মেক্সিকোয় লা লোরনা, পাকিস্তানে পিচাল পিয়ারি।
পুনর্জন্ম কিংবা মমির অস্তিত্ব উভয়ই সেই আদিযুগ থেকে পরলৌকিকতার বার্তা দেয়। যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানমনস্করা সব সময় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ভূতের অস্তিত্বে। তাঁরা বারবার বলেছেন, ভূত যে রয়েছে, তার প্রমাণ কোথায়? এর উত্তরে আবার ভূতবাদীরা পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, সে যে নেই, তার প্রমাণটাই বা কই?
জেন ডাইসন নামের এক গবেষক চলে যান ভারতের বামনি গ্রামে ভূতের দেখা পেতে। হিমালয়ের ভারতীয় অংশে বন–জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট এই গ্রাম বামনি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৯ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থান। দুর্গম বলে আশপাশের এলাকা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন গ্রামটি। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণের সময় পূর্বপুরুষের আত্মা কারও শরীরে ভর করে। বিয়ের আসরে কনের ওপর ভর করতে পারে সে আত্মা।
খ্রিষ্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০ সালে চীনের হান সাম্রাজ্যের সময় জীবিত ব্যক্তির সঙ্গে মৃত ব্যক্তির বিয়ের প্রচলন ছিল। মৃত ব্যক্তি যদি অবিবাহিত থাকত, তার পরিবার বিশ্বাস করত যে তার অতৃপ্ত আত্মা পরলোক থেকে ফিরে এসে পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা অন্য কারও ক্ষতি সাধন করতে পারে। সে কারণে তাকে সমাহিত করার সময় একজন জীবিত ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়। এ ধরনের ভূতকে বলা হয়ে থাকে জিয়াশিং। শুধু চীন নয়, জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ আফিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও আমেরিকায়ও আছে ভূতের বিয়ের প্রচলন।
পেতনি এই উপমহাদেশের ভূত বলে পরিচিত হলেও, মধ্য এশিয়া ও পারস্য থেকে মূল ধারণা আসে পেতনির। পেতনি হলো মেয়ে ভূত। যখন এশিয়ায় আগমন ঘটে, তখন কিছুটা বদল আসে এর গল্পে। শেওড়াগাছের এসব বাসিন্দা জীবদ্দশায় কিছু অতৃপ্ত বাসনা রেখে যায়। সেসব বাসনাকে মৃত্যুর পর পূরণ করাই তাদের উদ্দেশ্য। অবিবাহিত নারীরাই সাধারণত পেতনি হয় বলে শোনা যায়, তবে মতান্তরে গর্ভাবস্থায় মৃত্যু হওয়া নারীও পেতনি হতে পারে। পেতনিরূপ দেখতে ভালো না হলেও রূপ পাল্টানোর ক্ষমতা আছে এদের। অনেক ক্ষেত্রেই রূপসী নারীর বেশ নেয় তারা। যেসব পুরুষ তাদের মায়াজালে আটকে যায়, তাদের হয় প্রাণ কেড়ে নেয়, না হয় তারুণ্য কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধে পরিণত করে। পেতনিদের চেনার একটি ভালো উপায় হলো তাদের উল্টো পা। পাকিস্তানে পিচাল পিয়ারি আর ভারতে ‘চুরেল’ নামে ডাকা হয় এদের। এদের পাওয়া যায় হিমালয় অঞ্চলের পাহাড়ে, বিশেষ করে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চল ও পাঞ্জাবে।
বাঙালির কাছে সুপরিচিত ভূত হচ্ছে শাকচুন্নি। এর গায়ের রং শাকের মতো সবুজ। শব্দটা এসেছে সংস্কৃত ‘শঙ্খচূর্ণী’ থেকে। হিন্দু বিবাহিত নারীদের প্রতিনিধি ভূত বলা হয় একে। তার হাতে থাকবে শাঁখা–পলা, কপালে লাল সিঁদুর। মৃত্যুপরবর্তী জীবনে চরম একাকিত্বে ভোগে সে। জীবদ্দশায় সংসার করার শখ ভালোমতো মেটেনি। তাই প্রায়ই দেখা যায়, বিবাহিত নারীদের গাছের ওপর বন্দী করে রাখে, নয়তো তার শরীরে ভর করে আসে, ওই নারীর স্বামীর সঙ্গে সংসার করবে বলে। উত্তর আমেরিকার আদি নৃগোষ্ঠীর বিশ্বাস অনুযায়ী, এ ধরনের ভূতকে বলা হয় ‘দ্য ঘোস্ট ওয়াইফ’।
হ্যারি পটারের জগতে ‘হেডলেস নিক’ বা ‘স্লিপি হলো’ কিংবদন্তি হোক আর বাংলা সাহিত্যের তেপান্তর হোক, মাথাবিহীন ভূতদের বেশ দাপট আছে সবখানেই। এদের মৃত্যু সাধারণত অপঘাতে হয়ে থাকে। মাথা থাকে না বলেই এসব ভূতকে ‘স্কন্ধকাটা’ বলা হয়। কোনো দুর্ঘটনায় মাথা কাটা গেছে, এমন মানুষদের আত্মাই স্কন্ধকাটা ভূতে পরিণত হয় বলে জানা যায়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এসব ভূত সব সময় তাদের হারানো মাথার খোঁজ করে। ইউরোপে ‘হেডলেস হর্সম্যান’ নামে এক উপকথার চরিত্র আছে। মস্তকহীন এক ঘোড়সওয়ার তার ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের উপকথায় পাওয়া যায় এর অস্তিস্ব। আয়ারল্যান্ডের উপকথায় ‘দুলা-হান’ বা দ্য ডার্কম্যান একধরনের কালো শক্তিসম্পন্ন পরি, যে নিজের মাথা বাহুর নিচে রেখে মস্তকবিহীনভাবে ঘোড়ার পিঠে ঘুরে বেড়ায়। আমেরিকার টেক্সাসে একই রকমের চরিত্রকে বলে ‘এল মুয়েরতো’।
ইউরোপিয়ান দেশগুলোয় ‘স্লাম্বার পার্টি’ হলো ছেলেমেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার একটি ধাপ। বয়োসন্ধির কৌতূহলে তারা এমন কিছু খেলা বা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, যার ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা অবগত থাকে না। পশ্চিমা দেশগুলোয় ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক গেম’ খুবই পরিচিত একটি খেলা। বিশেষ করে তরুণ সমাজে এই খেলা প্রচলিত। এই খেলার নিয়মানুসারে অন্ধকার ঘরে মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে মৃত কোনো ব্যক্তির আত্মাকে আহ্বান করা হয়ে থাকে।
১৯৭৮ সালের দিকে স্লাম্বার পার্টিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এসব ব্ল্যাক ম্যাজিক গেম, যার মধ্যে ‘সামনিং অব ব্লাডি ম্যারি’ অন্যতম। তখনকার সময়ে আমেরিকায় প্রচলিত ছিল মধ্যরাতে কোনো অন্ধকার ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে আয়নার সামনে তিনবার ‘ব্লাডি ম্যারি’ উচ্চারণ করলে আয়নায় নিজের চেহারার বদলে ভেসে ওঠে এক বিকৃত নারীর অবয়ব, যার চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।
অনেক সময় সে স্বাভাবিকভাবেই অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার অনেক সময় সামনে থাকা ব্যক্তির মারাত্মক ক্ষতি করে এই অশরীরী আত্মা। এই আত্মার উপস্থিতির পর কেউ তাকে ‘আই স্টোল ইয়োর বেবি’, বললে সে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রচলিত আছে যে ‘ব্লাডি ম্যারি’র চ্যালেঞ্জ গ্রহণের পর অনেককেই খুঁজে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়, কেউ বা হারিয়ে গেছে চিরতরে। আবার বলা হয়, আয়নায় দেখা যাওয়া এই ব্লাডি ম্যারি হচ্ছে ইংল্যান্ডে রানি মেরি। তিনিই সেই ব্লাডি ম্যারি কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে ব্লাডি ম্যারি যিনিই হোন না কেন, তার এই মিথের পেছনে আসলেই কি কোনো সত্যতা আছে? পশ্চিমের অনেক নারীই দাবি করেন যে কম বয়সে তাঁরা ব্লাডি ম্যারি রিচুয়াল চর্চা করেছেন।
তাঁদের অনেকেই মোমবাতির আলোয় বাথরুমের আয়নায় স্বচক্ষে দেখেছেন ফ্যাকাশে, বিকৃত এক নারীর অবয়ব। মনোবিদেরা অবশ্য এর অন্য ব্যাখ্যা দেন। ইতালির মনোবিদ জিওভানি ক্যাপুতো এমন ৫০ নারীর ওপর সমীক্ষা চালান, যাঁরা ব্লাডি ম্যারিকে দেখেছেন বলে দাবি করেন। তাঁদের তিনি আয়নার দিকে ১০ মিনিট একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে বলেন। তাঁদের বেশির ভাগই হয় নিজেদের মুখ বিকৃত অবস্থায় দেখেন, নয়তো কোনো অপরিচিত বিকৃত মুখচ্ছবিকে আয়নায় ফুটে উঠতে দেখেন। কাপুতো জানান, চোখের নিউরনঘটিত সাময়িক সমস্যা মাঝেমধ্যে এই বিকৃতির জন্ম দেয়।
কাল পড়ুন শেষ পর্ব
ছবি: পেকজেলসডটকম