সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ফুটতে থাকা হৃদয়মনে তরুণ একদল প্রতিশ্রুতিবান আলোকচিত্রীদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বিপিএসের মাসিক সভায়! তখন মধ্য আশির দশক! আমি সদ্য আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ স্যারের বেগার্ট ফটোগ্রাফি স্কুল থেকে ফটোগ্রাফি কোর্স সম্পন্ন করেছি! পরে বেগ স্যারের পরামর্শে বিপিএসের সদস্য হই!
তখন বিপিএসের মাসিক সভা হতো প্রতি মাসের প্রথম রোববার সকালে। মাসিক সভায় ফটোগ্রাফি নিয়ে আলোচনা, ছবি নিয়ে প্রশ্নোত্তর ও সদস্যদের ছবি নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো!
আমি যেহেতু একেবারেই নতুন সদস্য, তাই বসতাম সবার পেছনে। মঞ্চে বসতেন মঞ্জুর আলম বেগ স্যার, রশিদ তালুকদার, বিজন সরকার, ব্রিগেডিয়ার আতিক ও ড. শহীদুল আলমদের মতো খ্যাতিমান আর বরেণ্য আলোকচিত্রীরা। পেছনে বসে মাথা নিচু করে কিংবদন্তিদের মুখাবয়ব দেখতাম আর তাঁদের মূল্যবান কথা মগজে প্রবেশ করাতাম।
সদস্য হওয়ার পর আমার দ্বিতীয় সভায় মাসিক প্রতিযোগিতায় রঙিন বিভাগে প্রথম হলে অনেকেই আমাকে বাহবা দেন। তাঁদের মধ্যে একজন একটু আলাদাভাবে প্রশংসা করেন আমার পুরস্কার পাওয়া ছবির এবং বলেন যে তোমার হাতে যে সার্টিফিকেট, তার লেখা আমার!
মানুষের হাতের লেখা মুক্তোর মতো ঝকঝকে ও সুন্দর হয়, তা প্রথম দেখলাম আমি এবং এই ব্যক্তিই হচ্ছেন আলোকচিত্রী চঞ্চল মাহমুদ!
ঝাঁকড়া চুল, জিনসের শার্ট পরা ও কাঁধে ঝোলানো তখন আমার স্বপ্নের ক্যামেরা ক্যানন! তাঁকে দেখব, না তাঁর ক্যামেরা দেখব, তা ভাবতে ভাবতেই চঞ্চল মাহমুদ হাত ধরে ছোঁ মেরে নিচতলায় নামিয়ে চায়ের স্টলে নিয়ে যান—এই দুই কাপ চা দাও মামা!
চঞ্চল মাহমুদের পাশে দাঁড়িয়ে চা পান করতে আমার স্বস্তি লাগছিল না! চায়ের চুমুকের ছলে আমি দেখছিলাম চঞ্চল মাহমুদের ফ্যাশন–সেন্স! তাঁর রুচিবোধ ও ব্যক্তিত্ব—সবই আমাকে আকর্ষণ করে।
বয়সে ছোট হলেও আমাকে চঞ্চল মাহমুদ আপন করে নিলেন চটজলদি! এরপর প্রায়ই চারুকলায় দেখা হতো আমাদের। আউটিংয়েও যাই তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন লোকেশনে ছবি তুলতে। সুপরামর্শ পেতে থাকি তাঁর কাছ থেকে। এভাবেই তাঁর খুব প্রিয় একজন হয়ে উঠি আমি! ততদিনে চঞ্চল মাহমুদ দেশের সেরা মডেল ও ফ্যাশন ফটোগ্রাফারের পদটি দখলে নিয়েছেন আপন দক্ষতায়।
এলিফ্যান্ট রোডের একটা গলির দোতলায় তাঁর স্টুডিও, নাম ফুজিম্যাক্স! এক সন্ধ্যায় গেলাম দেখা করতে! ছোট্ট সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে দেখি প্রচণ্ড ভিড়! তাঁর এক সহকারী আমায় দেখে বললেন, আজ যে দেখা করতে পারবেন না স্যারের সঙ্গে!
স্টুডিওর বাইরে অপেক্ষারত অনেক তরুণ–তরুণীকে দেখিয়ে বললেন, তাঁরা ছাড়া স্টুডিওর ভেতরে আছেন তখনকার তারকা মডেল তানিয়া, নোবেল, মৌ, পল্লবসহ অনেকেই!
ফিরে আসতে আসতে ভাবলাম, বাংলাদেশে এ–ও সম্ভব; একজন ফটোগ্রাফারের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়বে সারা দেশের সেরা সুন্দরী আর সুদর্শন যুবকেরা!
চঞ্চল মাহমুদ আমাদের ফ্যাশন ফটোগ্রাফিকে একটি শিল্পে পরিণত করেছেন। একজন ফটোগ্রাফারের ক্যারিশম্যাটিক ফটোগ্রাফিতে একটি পত্রিকা যে পাঠকের মন কেড়ে নিতে পারে, তার উদাহরণ ‘মূলধারা’ নামের একটি ফ্যাশন ম্যাগাজিন। ১৯৮৯ সালের দিকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনটি। এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন কবি শামসুর রাহমান আর সম্পাদক ও প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরী। প্রথমে ম্যাগাজিন, তারপর ট্যাবলয়েড আকারে রীতিমতো চমকে দেয় বিনোদনধর্মী পত্রিকাটি। ট্যাবলয়েডের প্রধান আকর্ষণ ছিল চঞ্চল মাহমুদের মনকাড়া ছবি, বিশেষ করে চঞ্চল মাহমুদের ভিন্নধর্মী ছবিগুলোর কারণে স্টলে স্টলে আলাদাভাবে নজর কাড়তে সক্ষম হয় ‘মূলধারা’। চঞ্চল মাহমুদের ক্যামেরায় যেকোনো বিষয়ই অনন্য হয়ে উঠেছে। ফ্যাশন ও মডেল ফটোগ্রাফার হিসেবে তাঁর সুনাম, প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তির কথা তো এই শহরের কারও অজানা ছিল না। তাঁর ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো ছিল অনেকের জীবনের স্বপ্ন। কত অভিনেত্রী, মডেল ও খ্যাতিমান ব্যক্তি তাঁর ক্যামেরাবন্দী হয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। অনেকেই তাঁর তোলা ছবি দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। গ্ল্যামার–জগতে তিনি হয়ে উঠেছেন আইকন।
পরবর্তী সময়ে চঞ্চল মাহমুদ দেশে ফটোগ্রাফার সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেন! শুরু করেন ফটোগ্রাফির শিক্ষকতা। ‘চঞ্চল মাহমুদ ফটোগ্রাফি’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন ফটোগ্রাফি স্কুল! হাতে–কলমে শিক্ষা নিয়ে এই স্কুল থেকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন অনেক তারকা আলোকচিত্রী, যাঁরা আজ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।
চঞ্চল মাহমুদ অকাতরে সন্তানতুল্য ছাত্রদের বিলিয়েছেন তাঁর মেধা ও মনন। আমাদের দেশের ফটোগ্রাফারদের পরিচিত করতে নামের আগে আরও অনেক রেফারেন্স দিয়ে দিতে হয়! একমাত্র চঞ্চল মাহমুদকে মানুষ চেনে একনামেই।
আমাকে সংক্ষেপে ‘এ এম’ নামে সম্বোধন করতেন। এর একটা কারণ হতে পারে, তাঁকে আমি ‘সি এম’ নামে ডাকতাম। তো একদিন চঞ্চল মাহমুদ আমাকে ফোন করে বললেন, এ এম আজ দুপুর ১২টায় চ্যানেল আইয়ের তারকাকথন লাইভ অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। আপনি দেখবেন অনুষ্ঠানটি এবং লাইভে প্রশ্ন করবেন। ঠিক আছে সি এম বলে আমি যথাসময়ে টিভির সামনে বসে পড়ি প্রশ্ন রেডি করে!
অনুষ্ঠানে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই চলছেন চঞ্চল মাহমুদের ভক্ত ও দর্শকেরা! আমি তন্ময় হয়ে টিভি দেখছি। কখন যে ঘণ্টাব্যাপী তারকাকথন শেষ হয়ে গেল, তা টেরই পেলাম না! প্রশ্ন আর করার সময় পেলাম কই?
আমাদের দেশে অনেক খ্যাতিমান আলোকচিত্রী আছেন, কিন্তু তারকা আলোকচিত্রী বা সেলিব্রিটি আলোকচিত্রী অনলি ওয়ান চঞ্চল মাহমুদ।
আমাদের দুজনের নামে মাহমুদ ও পেশায় মিল থাকায় অনেকেই জানতেন আমরা দুজন সহোদর! একবার আমার অসুস্থতার খোঁজ নিতে এসে দেখলেন, আমি ব্রাশ হাতে নিয়ে ক্যামেরা পরিষ্কার করছি। চঞ্চল মাহমুদ আমার পাশে বসে কানের কাছে এসে বললেন যে এ এম শোনেন, ক্যামেরার মতো নিজের যত্নও নিতে হয়! নিজেকে সময় দিতে হয়! একসময়ে অনেককে অকাতরে সাহায্য করা চঞ্চল মাহমুদ জীবনসায়াহ্নে এসে অর্থকষ্টে নিজের যত্ন কি নিতে পেরেছিলেন?
চঞ্চল মাহমুদ চলে গেলেন। মনে ভরে নিয়ে গেলেন আকাশসম অভিমান! কথাটি কি সত্যি নয়? শেষ করি প্রিয় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর প্রিয় কবিতার দুটি লাইন দিয়ে—
‘অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই।’
লেখক: আলোকচিত্রী
ছবি: লেখকের সংগ্রহ