সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে একেক সময় চলে একেক জিনিসের ট্রেন্ড। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবাই মেতে উঠেছে সান্ডা নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুঁ মারলেই দেখা যাচ্ছে কেউ সান্ডা ধরছে, কেউ রান্না করছে তো কেউ সান্ডার বিরিয়ানি খাচ্ছে। বিশেষ করে কথিত কফিলের ছেলের প্রিয় সান্ডা দিয়ে সয়লাব সামাজিক মাধ্যম। এই সান্ডা নিয়ে চলেছে নানা সমালোচনা-আলোচনাও। অনেকেই বলছে এটি খাওয়া ভালো, অনেকেই বলছেন এটি বিষাক্ত।
সান্ডা হলো ইউরোমাস্টিকস গণের অধীন একটি সরীসৃপ প্রাণী, যা দেখতে অনেকটা গুঁইসাপ কিংবা টিকটিকির মতো। সচরাচর মরুভূমিতেই দেখে মেলে এই প্রাণীটির। মরু অঞ্চলের বেদুইনরা দীর্ঘকাল ধরে সান্ডাকে খাদ্য ও ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বলা হয়ে থাকে এতে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন ও নানা স্বাস্থ্য উপকারিতা। তবে এই প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর পেছনে বাস্তবিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কতটা মজবুত, সেটিই এখন জানা দরকার। চলুন জেনে নেওয়া যাক, এ বিষয়ে বিজ্ঞান কী বলছে? আসলেই কী সান্ডা খাওয়া উচিত নাকি নয়?
লোকজ বিশ্বাস ও প্রচলিত ব্যবহার
আরব, পাকিস্তান, ভারতসহ বেশ কিছু অঞ্চলে স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে সান্ডার মাংস ও তেল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা রকম লোকজ বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। বহু মানুষ বিশ্বাস করেন, সান্ডার তেল বা মাংস কিছু নির্দিষ্ট রোগ নিরাময়ে উপকারী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
১. হাঁপানি উপশমে সহায়ক বলে মনে করা হয়,
২. যৌন দুর্বলতা দূরীকরণে কার্যকর,
৩. বাত বা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা হ্রাসে সহায়ক।
এই দাবিগুলো সাধারণত প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লোকমুখে প্রচারিত হয়ে আসছে এবং অনেকেই এগুলোকে পরীক্ষিত সত্য হিসেবেই ধরে নেন। তবে সমস্যা হলো, এ ধরণের লোকজ বিশ্বাসের পেছনে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বা মেডিকেল রিসার্চ এই দাবিগুলোর অধিকাংশকেই এখন পর্যন্ত সমর্থন করেনি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো মেডিকেল জার্নালে এখনো এমন কোনো গবেষণা প্রকাশিত হয়নি যেখানে বলা হয়েছে যে, সান্ডার তেল বা মাংস সত্যিই এসব শারীরিক সমস্যার জন্য কার্যকর। ফলে এসব দাবিকে বিজ্ঞানসম্মত নয় বরং লোকজ বিশ্বাস হিসেবেই দেখা হয়।
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তা
প্রাকৃতিক উপাদানভিত্তিক ওষুধ বা খাবার কখনো কখনো উপকারী হতে পারে, তবে সেগুলো যদি বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত না হয়, তাহলে এগুলোর ব্যবহারে কিছু গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যেমন—
১. অপরীক্ষিত প্রাকৃতিক ওষুধ ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কারণ সেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পূর্বানুমান করা যায় না।
২. এসব উপাদান অন্য ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে ক্ষতিকর ফল দিতে পারে, বিশেষ করে যদি কেউ নিয়মিত কোনো ওষুধ গ্রহণ করে থাকেন।
৩. ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়াজাতকরণ বা সংরক্ষণে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয়, যা মারাত্মক হতে পারে।
৪. শরীরে অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া (যেমন অ্যালার্জি, বমি, ডায়রিয়া, রক্তচাপ ওঠানামা) হতে পারে যা চিকিৎসা ছাড়াও জটিলতা তৈরি করতে পারে।
সান্ডার মতো বন্য প্রাণী শিকার ও তা নিয়ে বাণিজ্যিক লেনদেন বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই অবৈধ। অতিরিক্ত শিকার ও অপরিকল্পিত ব্যবহার এই প্রাণীটিকে ধীরে ধীরে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্রাণী কল্যাণের দিক থেকেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষ্য়। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় বন্য প্রাণীদের সংরক্ষণ আমাদের একটি নৈতিক দায়িত্ব। যদি কেউ হাঁপানি, যৌন দুর্বলতা কিংবা আর্থ্রাইটিসের মতো রোগে ভুগে থাকেন, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এসব সমস্যার জন্য কার্যকর, নিরাপদ এবং নিয়মিত পরীক্ষিত চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ রয়েছে।
সান্ডা খাওয়া বা এর তেল ব্যবহার নিয়ে অনেক গল্প, গুজব ও লোককাহিনী থাকলেও এখন পর্যন্ত এর কার্যকারিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই প্রচলিত ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোনো কিছু গ্রহণ না করাই ভালো। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত—যে কোনো খাবার বা ওষুধ গ্রহণের আগে তথ্য যাচাই করা, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি সচেতন ও দায়িত্বশীল থাকা।
তথ্য: হেলথলাইন, আরব নিউজ, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট
ছবি: উইকিপিডিয়া ও ইন্সটাগ্রাম