কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। সূর্যোদয়–সূর্যাস্ত, বালুরাশি আর নোনাজলের ঢেউয়ের ডাকে প্রতিবছর হাজারো মানুষ ছুটে যান এখানে একটুখানি প্রশান্তির আশায়। বিশেষ করে ঈদের লম্বা ছুটিতে লক্ষাধিক পর্যটক পাড়ি জমিয়েছেন কক্সবাজারে। কিন্তু এই প্রশান্তির জায়গাটিই হয়ে উঠছে শঙ্কার কারণ। সৈকতের পানিতে ডুবে পর্যটকের মৃত্যু ঘটেই চলেছে। এবার এক দিনেই ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। জানা গেছে, অসতর্কতার কারণে ‘গুপ্ত খাল’ কিংবা ভয়ংকর ‘রিপ কারেন্টের’ ফাঁদে পড়ে যাওয়া।
সমুদ্রবিজ্ঞানীদের মতে, কোনো গুপ্ত খাল নয়, এটি স্রোতের প্রভাব। যাকে সমুদ্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘রিপ কারেন্ট’ বলা হয়। এটি সমুদ্র উপকূলের স্থানীয় স্রোত, যা উপকূলরেখা থেকে সমুদ্রের দিকে, তীরের একেবারে কোণে প্রবাহিত হয়, যার কারণে একে গুপ্ত খাল বলেন অনেকেই।
রিপ কারেন্ট হলো সমুদ্রতলের নিচ দিয়ে স্থল থেকে গভীর সাগরের দিকে অত্যন্ত দ্রুতগামী পানির ধারা। এটি সাধারণত তীরের কাছে ঢেউ ভাঙার পরে ফিরে যাওয়ার সময় তৈরি হয়। দেখতে নিরীহ মনে হলেও এর গতি ঘণ্টায় প্রায় আট কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে, যা একজন দক্ষ সাঁতারুকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই চোরা স্রোত প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। সম্প্রতি কক্সবাজারে পর্যটকদের মৃত্যুর পেছনেও এই রিপ কারেন্ট একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। রিপ কারেন্ট মানুষকে পানির নিচের দিকে টেনে ডুবিয়ে দেয় না; বরং উপকূল থেকে অনেক দূরে টেনে নিয়ে যায়।
রিপ স্রোত সাধারণত নিচের দিকে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়, যার ফলে একজন পর্যটকের পা নিচ থেকে ছিটকে যেতে পারে, যাতে তার মনে হয় যেন পানির নিচে কিছু একটা তাকে টানছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও তীরের দিকে প্রবল শক্তিতে সাঁতার কাটতে থাকে ও একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে সাগরে ভেসে যায়। ভয়, আতঙ্ক, ক্লান্তি বা সাঁতারের দক্ষতার অভাবেই মৃত্যু হয় এই উল্টো স্রোতের কবলে পড়া অধিকাংশ মানুষের।
এই মৃত্যুফাঁদে পড়ে মৃত্যুর পুনরাবৃত্তির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ ও সংবাদমাধ্যমে বলছে—১. পর্যাপ্ত সতর্কতা না মেনে যত্রতত্র গোসলে নামা; ২. লাইফগার্ডের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে যাওয়া; ৩. পর্যবেক্ষণ ছাড়া শিশু বা বয়স্কদের পানিতে নামতে দেওয়া; ৪. পর্যাপ্ত উদ্ধারকর্মীর অভাব ও ভ্রমণকারীদের অসতর্ক থাকা।
১. সমুদ্রের একটি নির্দিষ্ট অংশে পানি তুলনামূলক ঘোলা ও বেশি সাদা ফেনাযুক্ত হলে। ২. একটি নির্দিষ্ট দিকের পানি অন্যদিকের চেয়ে বেশি টানছে বা স্রোতের ধরন অন্য রকম মনে হলে।
ঢেউ না থেকেও হঠাৎ এক জায়গায় পানি অনেক শক্তিশালী গতিতে প্রবাহিত হতে থাকলে।
১. ভয় পাবেন না, মাথা ঠান্ডা রাখুন। ২. সোজাসুজি তীরে ফেরার চেষ্টা না করে, স্রোতের সঙ্গে সমান্তরালে (পাশ দিয়ে) সাঁতার কাটুন। ৩. স্রোত থেকে বের হয়ে তারপর তীরের দিকে আসুন। ৪. সাঁতার না জানলে বা ক্লান্ত হলে পিঠের ওপর ভেসে থাকুন ও সাহায্যের জন্য হাত দিয়ে ইশারা করুন।
১. লাইফগার্ড বা নিরাপত্তাকর্মীদের নির্দেশনা মেনে চলুন। ২. লাল পতাকা বা নিষেধাজ্ঞা চিহ্নিত এলাকায় পানিতে নামবেন না। ৩. রিপ কারেন্ট সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং অন্যদেরও জানান। ৪. পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের বিশেষভাবে নজরে রাখুন, তাঁদের একা পানিতে নামতে দেবেন না। ৫. জোয়ার-ভাটার সময় সম্পর্কে জানুন, জোয়ারের সময় পানির স্রোত অনেক বেশি হয়। এই সময় দূরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। ৬. বিপদে পড়লে চিৎকার না করে ভেসে থাকার চেষ্টা করুন।
১. প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড স্থাপন। ২.অতিরিক্ত লাইফগার্ড নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ। ৩.সমুদ্রসৈকতে নিয়মিত সচেতনতামূলক ঘোষণা। ৪.পর্যটকসুলভ
সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করুন, তবে সচেতনভাবে। একটু সতর্কতা আপনাকে বাঁচাতে পারে প্রাণঘাতী ঝুঁকি থেকে। ছুটির আনন্দ যেন কান্নায় রূপ না নেয়, নিরাপদ ভ্রমণেই আসুক প্রকৃত প্রশান্তি। ভালোবাসুন সমুদ্রকে, কিন্তু জানুন তার আচরণও।
ছবি: প্রথম আলো