পুতুলের ভেতর আটকে থাকে অশরীরী আত্মা, আপাতদৃষ্টে দেখতে প্রাণহীন এই পুতুল, বাড়িতে ঢুকে ঘটাতে থাকে একের পর এক অশরীরী ঘটনা। হরর মুভি ‘অ্যানাবেল’ দেখেছেন অনেকেই। মুভির এই চরিত্র আমেরিকায় প্রচলিত ভৌতিক গল্পের চরিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের লোককাহিনির কিংবদন্তি হচ্ছে বেল উইচ। ১৮১৭ থেকে ১৮২১ সালের মধ্যে কৃষক জন বেল তার পরিবার নিয়ে এখানে থাকতে শুরু করেন। তাদের পুরো পরিবার ভৌতিক এক আওয়াজ শুনে তার দ্বারা সম্মোহিত হয় এবং ওই সময় অনেকেই এই বেল উইচের দ্বারা বিমোহিত হয়। আরেক কিংবদন্তি পুতুল ‘অ্যানাবেল’, যার দেহে আটকে আছে অপঘাতে মৃত সাত বছরের এক বালিকার আত্মা। পৃথিবীর অনেক দেশেই পুতুলের ভেতর ভৌতিক কিছুর উপস্থিতিকে বিশ্বাস করা হয়।
হাজার বছর ধরে জাপানি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে ওনি এবং ইউরেই। ওনি হলো মানবসদৃশ অতিকায় আকৃতির শিংওয়ালা দানব। মিথে তাদের হাজির হতে দেখা যায় অনিষ্টকারী হিসেবে। পাপী ব্যক্তি মৃত্যুর পর নির্দিষ্ট নরকে পতিত হলে ওনিতে পরিণত হয়। হয়ে ওঠে নরকের দেবতার মতোই হিংস্র আর নিষ্ঠুর। নরকে তাদের সংখ্যা অনেক। তবে দুনিয়ায় থাকতেই যারা পাপের ভারে সব রকম ক্ষমার অযোগ্য হয়ে উঠেছে, তারা জীবিত অবস্থায়ই ওনিতে পরিণত হয়। জাপানি বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পর আত্মার প্রত্যাশিত গন্তব্য ইয়োমিনোকুনি।
কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথটা দুর্গম; যাত্রাটাও কষ্টসাধ্য। তাই নিকটাত্মীয়দের কেউ মারা গেলে জীবিতদের নির্ধারিত আচার পালন করতে হয়। সাহায্য করতে হয় মৃতের আত্মার পরকালীন অভিযাত্রায়। সফল হলে মুক্তিপ্রাপ্ত আত্মা জীবিতদের জন্য সাহায্য ও সৌভাগ্য নিয়ে আসে। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করা কিংবা সঠিকভাবে শেষকৃত্য না পাওয়া এসব আত্মার পার্থিব হিসাবনিকাশ বাকি থাকে; তাই তারা ইহকাল ও পরকালের মধ্যে আটকে থাকে। সেই অতৃপ্ত আত্মাই পরিচিত ইউরেই নামে। বিভিন্ন সময়ে ওনি আর ইউরেই নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র গল্প। কিয়োহিমে, ওনরোয়ো, উকি-ওনা, শুতেন-তোজি, ইয়ামায়ুবা, উজি নো হাশিহিমে ইত্যাদি নানা রকম অশরীরী প্রেতাত্মা রয়েছে যা জাপানি লোকসংস্কৃতির অংশ। জাপানে উপকারী ভূতও আছে, যার নাম ‘শিন্তো’।
মেক্সিকো এমনিতেই মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতার নিবাসের জন্য রহস্যময়তায় ঘিরে আছে। মেক্সিকানরা বিশ্বাস করে যে তাদের মৃত স্বজনেরা সব সময়ই তাদের পাশে থাকে। ধর্মীয়ভাবে তাই তাঁদের স্মরণে আচার–অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেখানে মৃতদেহের খুলিতে রত্ন বসানো হয়, এমনকি তাঁদের জন্য খাবার, পোশাকসহ যাপিত জীবনের সব আয়োজন রাখা হয়। কারণ, মেক্সিকানরা বিশ্বাস করে, তাদের আদিপুরুষেরা তাদের সঙ্গেই বসবাস করছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই সংস্কৃতি ও অঞ্চলভিত্তিক নিজস্ব প্রাচীন লোকগাথা বিদ্যমান।
এর মধ্যে বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে ভূত-প্রেত, অশরীরী, আত্মা ও পৈশাচিক শক্তিকে কেন্দ্র করে। ‘লা ইয়োরোনা’ তেমনই এক প্রাচীন মেক্সিকান বিখ্যাত মৌখিক কিংবদন্তি, যেখানে ক্রন্দনরত এক অশরীরী নারী আত্মার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। মেক্সিকোর অনেক শিশু বেড়ে ওঠে লা ইয়োরোনার ভয় সঙ্গে নিয়েই। উপকথায় এমন এক নারীর কথা বলা হয়েছে, যে তার দুই ছেলের আত্মা না পাওয়া পর্যন্ত স্বর্গে প্রবেশ করতে অস্বীকার করে। যারা আধিভৌতিক কাহিনি জানতে পছন্দ করেন, এমন ভূত-গল্পপ্রেমীদের কাছে ‘লা ইয়োরোনা’ বিশেষ জনপ্রিয়।
জ্যামাইকার প্রেতাত্মার নাম ‘ডাপি’। বলা হয়ে থাকে যে এর আগমন পশ্চিম আফ্রিকা থেকে। ক্রীতদাস প্রথার সময় এই অশরীরী আসে জ্যামাইকায়। জ্যামাইকার আইকনিক সংগীতশিল্পী বব মার্লের গানেও রয়েছে এই ডাপির কথা। মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করার জন্য জ্যামাইকায় একটি প্রথা আছে, যেখানে রাম পান করা হয় এবং ডাপিদের জন্যও রাম পরিবেশন করা হয়। রোলিং কালফ বা রক্তলাল চোখের ডাপি মানুষকে আক্রমণ করে অন্ধকারে একা রাস্তায়। পকেটে একমুঠো বালি রেখে বা কালো কিছুতে মোড়ানো ছুরি রাখলে এর থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীর মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্নতার প্রভাব খুব বেশি। সে কারণে দেখা যায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, চীন, ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে প্রেত–লৌকিকতা নিয়ে নানা গল্প, যা আধুনিক যুগে এসেও লাইফস্টাইলের সঙ্গে মিশে গেছে। ইন্দোনেশিয়ায় এক বিশেষ ধরনের নৃগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মধ্যে কেউ সবুজ পোশাক পরে না। ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণের ‘ইয়োগি আকার্তা’ সমুদ্রের রানি ‘রাতু কিডুল’ সবুজ পোশাক পরে, তাই এই পোশাকে কেউ সমুদ্রে নামলে তাকে সমুদ্র গ্রাস করে নেয়। ইন্ডিগো কিডস হলো অতিন্দ্রীয় ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু, যাদের মধ্যে থাকে পরলৌকিক জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা। ‘কুন্তিলনক’ নামের আরেক প্রেতাত্মা আছে, যারা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যায়, তারাই অশরীরী হয়ে ফিরে আসে। লম্বা কালো চুল আর সাদা পোশাক এবং চোখের জায়গায় দুটি কালো গর্ত। ক্ল্যাসিক এই ভূতকে প্রায়ই দেখা যায় কোরিয়ান বা জাপানি ভৌতিক চলচ্চিত্রে।
প্রতিটি দেশে শহর থেকে গ্রামের দিকে গেলেই শোনা যায় অশরীরী কিছুর গল্প, যার নাম ‘আরবান লিজেন্ড’। ফিলিপাইনে দীর্ঘ সময় স্প্যানিশ উপনিবেশ ছিল। সে কারণেই ফিলিপাইনের লোককথায় রয়েছে এর প্রভাব। ফিলিপাইনে মৃতকে বলা হয় ‘মুলত’ যা এসেছে স্প্যানিশ ‘মুলিত’ থেকে। ফিলিপাইনের সবচেয়ে পরিচিত প্রেতাত্মা হচ্ছে ‘মানামাঙ্গাল’। যে দিনের বেলায় খুব সুন্দরী রমণী হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু রাত হলেই দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে বাদুড়রূপে ঘুড়ে বেড়ায়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের গর্ভে থাকা শিশু তার পছন্দের খাবার, সে মাংস ও রক্ত খেয়ে থাকে। তার রয়েছে লম্বা জিহ্বা। রসুন, আদা, লবণ রাখলে মানামাঙ্গাল আপনার ধারকাছে ঘেঁষবে না বলে ধারণা করা হয়। (শেষ)
ছবি: পেকেজলসডটকম ও উইকিপিডিয়া