একজন সম্ভাব্য ধর্ষক কেমন হয়? সেকি সাইকোপ্যাথ নাকি অসামাজিক? সর্বদা প্রকাশ্যে নারীদের উত্ত্যক্ত করতে থাকে? তার দৃষ্টির লোলুপতা স্পষ্টভাবে দেখা যায়? বিশ্বের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, ধর্ষক বা ধর্ষকামী মানুষেরা তাদের পরিমণ্ডলে ভালোভাবে মিশে যেতে পারে। ব্যতিক্রমী কিছু কেস ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আপনার–আমার মতো স্বাভাবিক মানুষের জীবন যাপন করে।
আমাদের সমাজে মেয়েদের শেখানো হয়, অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলবে না, রাস্তাঘাটে সাবধানে চলবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবে বা একা চলাফেরা করবে না। আমাদের মেয়েরা সেই সব নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেও ধর্ষণের শিকার হয়। একই সঙ্গে সামাজিকভাবে আঙুল তোলা হয়, যথাযথ পোশাক কেন পরেনি, বুঝেশুনে কেন বাসে ওঠেনি, পথ চলতে কেন পেছনে বারবার ফিরে দেখেনি, লাস্ট মেট্রোতে কেন বাড়ি ফিরেছে—এই সব প্রশ্নের।
একেকটি মেয়ে যেন একেকটি স্ক্যানিং মেশিন হয়ে পথ চলে, আমাদের সমাজ এটাই চায়। কিন্তু এত কিছুর পরেও শেষ রক্ষা হয় না। নারী নয় শুধু, শিশু নিপীড়ন ও ধর্ষণ জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে, যা একটি সমাজের অস্থিতিশীল অবকাঠামোকেই স্পষ্ট করে।
একজন ধর্ষক হতে পারে মেট্রোতে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি, আপনার হাউজিং সোসাইটির কেয়ারটেকার বা সেই নতুন কলিগ যে সবে কর্মক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব শুরু করেছে। কিন্তু একটি পুরুষ যে আমাদের মতো একই সমাজের অংশ, তার ধর্ষক হয়ে ওঠার কারণগুলো কী হতে পারে!
সমাজবিদদের মতে, বছরের পর বছর ধরে সভ্যতা পুরুষপ্রধান থেকে নারী–পুরুষের সমতার দিকে বিকশিত হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যবশত কিছুসংখ্যক পুরুষ এটা মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং তারা মনে করে নারীকে পদদলিত করা তাদের জন্মগত অধিকার। তারা অনুভব করে যে কোনো নারীকে স্থায়ী শিক্ষা দেওয়ার এর চেয়ে ভালো হাতিয়ার আর হয় না। মনোবিদদের মতে, ধর্ষক পুরুষেরা সাধারণত আধিপত্য বা কর্তৃত্ব দেখাতে চায়। তারা নারীকে হেয় করে তৃপ্তি ও সুখ অনুভব করে এবং মনে করে যে নারীরা এটারই যোগ্য। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, ধর্ষকেরা অতিরিক্ত রকম আগ্রাসী মনোভাব রাখে, যা তারা স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকাশ করে না। ধর্ষকেরা সিজোয়েড, স্যাডিস্টিক এবং প্যাসিভ-অ্যাগ্রেশন জটিলতায় ভোগে।
কিছু ক্ষেত্রে শৈশবের অভিজ্ঞতা তাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। শৈশবকালের শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার ইতিহাস যেমন পরিবারের সদস্যদের থেকে নিগ্রহ, রাগ ও ঘৃণার অভিজ্ঞতা একটি স্বাভাবিক শিশুর মাঝে মানসিক অবসাদ নিয়ে আসে। সে নিজেকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করতে থাকে। ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে যদি কাউকে অধিকার করতে হয় অথবা ভালোবাসতে হয়, তবে বলপ্রয়োগ এর একমাত্র উপায়।
ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব অত্যন্ত জটিল। বিষয়টিকে সরলীকরণের কোনো উপায় নেই। তারপরও কিছু বিপৎসংকেত আমরা বিশেষ বিবেচনায় রাখতে পারি, যেগুলো সচেতন করবে আমাদেরকে বিপদের হাত থেকে।
অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত স্পর্শ
অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা এবং রাগের বিস্ফোরণ
বিনা কারণে মৌখিক এবং শারীরিকভাবে সহিংস আচরণ
টিজিং বা বুলিইং করা
অন্যদের ভয়ানক পরিণতির হুমকি দেওয়া
সন্দেহজনক ও প্যারানয়েড আচরণ
নিজেকে উত্তেজিত করতে সময় ব্যয় করা, সেটা হতে পারে পর্নোগ্রাফিক সাইট সার্ফিং
নৈতিকতা ও এমপ্যাথির অভাব
মিথ্যা বলা ও নিজের ছোটখাটো অপরাধ লুকানো
বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে সামাজিকভাবে কথা বলার সময় আচরণগত অস্বস্তির বহিঃপ্রকাশ
অপরিপক্ব চিন্তাভাবনা, বন্ধুদের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হওয়া
যোগাযোগশৈলীর অভাব। এরা কাউকেই কিছু বলে বোঝায় না। বরং মারমুখী হয় বা উঠে চলে যায়।
যে বিষয়গুলোতে নারীদের বিশেষভাবে সাবধান হওয়া উচিত
কারও কাছ থেকে অযাচিত স্পর্শ
অপরিচিতদের অস্বাভাবিক তাকানো এবং স্টকিং
মেসেজে বা সরাসরি নারীর ব্যক্তিগত বিষয়, শরীর বা গোপনাঙ্গ নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য
বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ হওয়া সত্ত্বেও যদি তা নারীর জন্য বিরক্তিকর অনুভূতি দেয়
কর্মক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শত্রুতা
ধর্ষণকে সারা বিশ্বে সবচেয়ে কম রিপোর্ট করা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।পরিবর্তিত সমাজ আরও ভোগবাদী এবং ব্যক্তিবাদী হয়ে উঠছে, মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। যখন ভালোবাসা, সহানুভূতি, স্নেহ আর গ্রহণযোগ্যতা দুষ্প্রাপ্য হয়, তখন মানুষ নেতিবাচক হয়ে ওঠে। আর এর ফলাফল হয় ভয়ংকর।
লেখক : সাইকোসোশ্যাল থেরাপিস্ট (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত)