১৫০ কেজি ওজন থেকে যেভাবে এখন ৭২ কেজি এই আলোকচিত্রী
শেয়ার করুন
ফলো করুন

তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব ছবি তোলেন। সেই সূত্রেই পরিচয়। উইকিমিডিয়ায় পৃথিবীর সেরা ছবির পুরস্কার পাওয়ার গল্প লিখেছিলাম প্রথম আলোয়। সেই সূত্রেই তাঁর সবটা জানা। ছবি তুলতে গিয়ে ওজন একটা বড় বাধা। একটা সময় সেই ওজন হয়ে যায় ১৫০ কেজির মতো। অদম্য চেষ্টায় এখন ৭২ কেজি। কীভাবে এই চেষ্টায় সফল হলেন সেই গল্প বললেন তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব।

আমার নামের মতো আমার জীবনের একটা বড় বিপ্লব হলো অতিরিক্ত ওজনের সঙ্গে লড়াই করা এবং সেই লড়াই থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসা। এই গল্প কেবল আমার নয়, এটা তাঁদের জন্য, যাঁরা ওজন বাড়ার কারণে শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন এবং নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইছেন।

নিজের মুখে নিজের গল্প

পরিবারের সঙ্গে তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব
পরিবারের সঙ্গে তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব

আমার নাম তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব। বগুড়ায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা। স্কুল-কলেজও বগুড়াতেই শেষ করেছি। ছোটবেলায় খুবই হ্যাংলা-পাতলা ছিলাম। খেলাধুলা খুব পছন্দ করতাম। সেই সময় ওজন মাপা হয়নি কখনো। পড়াশোনা শেষ করে যখন ব্যবসা শুরু করলাম, তখন ওজন ছিল ৮৯-৯২ কেজির মতো। ওজন বাড়ার গল্প মূলত শুরু হয় ২০১১ সালের দিকে, বিয়ের পর। তখন ওজন ১০০ কেজি ছাড়িয়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে আরও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছি, ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিয়েছি, অনেক টেস্ট করিয়েছি। কিন্তু রিপোর্ট সব ঠিক থাকায় মনের আনন্দে খাওয়াদাওয়া করতাম। মাঝেমধ্যে ফটোগ্রাফি করতাম, হাঁটাহাঁটি হতো শুধু ছবি তোলার সময়। বাকি সময় অফিসে বসে থাকতাম আর খেতাম। খাওয়া ছিল আমার পছন্দের বিষয়। সে সময় ক্যালরির হিসাব বোঝার কোনো ধারণা ছিল না। সকালে মাটন খিচুড়ি, দুপুরে বিরিয়ানি, বিকেলে ফুচকা-চটপটি, রাতে বাসায় ভাত—এভাবেই দিন চলত। দিনে প্রায় ৪-৫ হাজার ক্যালরি গ্রহণ করতাম। এভাবে চলতে চলতে ওজন বেড়ে দাঁড়াল ১৪৯ কেজি। ভাগ্যিস, ওজন বেড়ে ১৫০ কেজি হয়নি, সেটাই ছিল একমাত্র স্বস্তি। কিন্তু এই ওজনের সঙ্গে অনেক শারীরিক সমস্যাও দেখা দিল।

শারীরিক জটিলতা এবং প্রথম ধাক্কা

নিজের আলোকচিত্রের সঙ্গে   বিপ্লব
নিজের আলোকচিত্রের সঙ্গে বিপ্লব

২০০৬ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় দুটি ডিস্ক প্রল্যাপস হয়। ২০০৭ সালে অপারেশন করাই। একই বছরে নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমাই। ২০১১ সালে বিয়ে করি। এরপর ওজনের কারণে পিঠের ব্যথা বাড়তে থাকে। আগে দুটি ডিস্কে সমস্যা ছিল, পরে আরও ডিস্কে সমস্যা দেখা দেয়। ব্যথার কারণে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। চিকিৎসক ওজন কমানোর পরামর্শ দিতেন। সার্জারি করতে বলতেন, কিন্তু ভয় পেতাম। তাই পিছিয়ে যেতাম। প্রথম বড় ধাক্কা আসে, আমার এক ঘনিষ্ঠ ছোট ভাই অল্প বয়সে মারা গেলে।

বিজ্ঞাপন

ফটোগ্রাফি ও ড. আলিম ভাই

ফটোগ্রাফির সুবাদে ড. আলিম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি একদিন আমাকে ভয় দেখিয়ে বললেন, ‘তুমি তো মারা যাবে। তোমার বিএমআই অনেক বেশি। এই ওজন নিয়ে কেউ তোমার কফিনও তুলবে না।’

তিনি আরও কথা বলে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করলেন। তাঁর কথা যুক্তিসংগত ছিল; ফলে প্রথমবারের মতো আমি ভাবতে বাধ্য হই, আমি সত্যিই এমন পরিস্থিতিতে আছি। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিই গ্যাস্ট্রিক বাইপাস করাব অর্থাৎ পাকস্থলী কেটে ছোট করে ফেলব।

আলোকচিত্রী বন্ধুদের সঙ্গে  বিপ্লব
আলোকচিত্রী বন্ধুদের সঙ্গে বিপ্লব

গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারির প্রথম পদক্ষেপ

অবশেষে ২০২০ সালে ব্যাংককে গিয়ে গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি করাই। এটা ছিল আমার প্রথম পদক্ষেপ। তবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। পরিবারের কেউই রাজি ছিলেন না। সবাই মনে করেছিল, এটি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমার স্ত্রীর মানসিক সাপোর্ট আমাকে সবচেয়ে বেশি শক্তি দেয়। সে বলেছিল, ‘তুমি পারবে। এটা শুধু তোমার জন্য নয়, আমাদের পুরো পরিবারের জন্য।’ তত দিনে আমার জীবন নরক হয়ে উঠেছিল। রিকশায় ওঠা যেত না, বাসে এক সিটে বসা সম্ভব ছিল না। প্লেনের ইকোনমি ক্লাসে বসতে পারতাম না। গাড়ির ড্রাইভিং সিটেও জায়গা হতো না। পছন্দমতো পোশাক পরা ছিল অসম্ভব। মানুষ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত। সব মিলিয়ে মনে হতো, আত্মহত্যা করি। ২০২০ সালে ব্যাংকক হাসপাতালে গিয়ে সার্জারি করালাম। তখন ওজন ১৪৯ কেজি থেকে ১০৩ কেজিতে নেমে আসে। মনে করলাম সব সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিন্তু না। আবার ওজন বাড়তে শুরু করল, সঙ্গে পিঠের ব্যথাও।

আবার ওজন বৃদ্ধি এবং নতুন যুদ্ধের শুরু

২০২১ সালে আবার ওজন বাড়া শুরু হয়। ২০২২ সালে ১০৩ কেজি থেকে ১২০ কেজিতে পৌঁছাই। একই সঙ্গে ব্যাক পেইনও ফিরে এল। এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হই। চিকিৎসক জানান, এভাবে চললে আবার সার্জারি করতে হবে। শারীরিক অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল যে বিছানা থেকে নড়তে পারতাম না। লোয়ার ব্যাক, পিঠ এবং ঘাড় মিলিয়ে মোট ১১টি ডিস্কে সমস্যা ধরা পড়ল। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে দ্বিতীয়বার অপারেশন করালাম। ৮টি স্ক্রু এবং ২টি প্লেট বসানো হলো। কিন্তু অপারেশনের পর ব্যাংককে গিয়ে জানলাম, স্ক্রুগুলোর মধ্যে ২টি ঠিকমতো বসেনি। চিকিৎসক বললেন, ডায়েট করতে হবে। ওজন কমাতে না পারলে কিছুই সম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

ডায়েটের কঠোর পরিকল্পনা

২০২৪ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ডায়েট শুরু করি। ওজন তখন ১১৯ কেজি। এই যাত্রায় আমি নিজেকে পুরোপুরি সিরিয়াস করে তুলি।

ওজন কামানোর পর তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব
ওজন কামানোর পর তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব

প্রথমে যা করি

* চিনি বাদ দিই।

* বাইরের খাবার একদম খাওয়া বন্ধ করি।

* ক্যালরি হিসাব শিখি। তখন আমার দৈনিক ১ হাজার ৮০০ ক্যালরি দরকার হতো।

* এর থেকে কম খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

খাবারের পরিকল্পনা

* সকালে ২টা সেদ্ধ ডিম, দুপুরে ৫০ গ্রাম ভাত, ৫০ গ্রাম সবজি আর ২০০ গ্রাম মাছ বা মুরগি।

* বিকেলে ১০০ গ্রামের মতো ভাজা ভুট্টা বা ছোলা।

* সন্ধ্যায় সেদ্ধ ডিম, মাছ বা মাংস। খাবারের মেনু প্রতিদিন পরিবর্তন করি, কিন্তু ক্যালরি ১ হাজার ৮০০-এর নিচে রাখি।

ফলাফল

ডায়েট শুরু করে অক্টোবরে এসে ৭২ কেজিতে পৌঁছাই। লক্ষ্য ছিল ৯৯ কেজিতে নামা, কিন্তু ৭২ কেজিতে নেমে আসাটা ছিল আমার কল্পনাতীত।

নতুন জীবন এবং মানসিক পরিবর্তন

১০০ কেজির নিচে নামার দিন মনে হলো, আমি যেন বিশ্ব জয় করেছি। এখন আমার প্যান্টের সাইজ ৩২। আগে ছিল ৫৮। শার্ট লাগে এল সাইজ। আগে যেখানে সিক্সএক্সএল ছাড়া কিছুই পরা যেত না, এখন নিজের পছন্দমতো পোশাক পরতে পারি।
মজার বিষয় হলো, যারা একসময় পরামর্শ দিত এবং আমার অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা করত, এখন তারাই আমাকে দেখে হতবাক। আবার কেউ কেউ বলেন, ‘তোমাকে চিনতে পারছি না।’ মানুষের মন্তব্যের বিষয়ে কিছু না বললেই নয়। মোটা থাকার সময় তারা বলত, ‘নেশা করে।’ এখন কম ওজন দেখে একই কথা বলে। তবে এসব মন্তব্য এখন আর আমাকে প্রভাবিত করে না।

পরামর্শ ওঅভিজ্ঞতা

আমি এখন বুঝি, শরীরের জন্য কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, শাকসবজি সবই দরকার। তবে পরিমাণটা বুঝতে হবে। আমি এখন অনেক ফিট।

গলফ খেলতে গেলে ৯ হোল খেলা সম্ভব ছিল না, হাঁপিয়ে যেতাম; কিন্তু এখন ৯ হোল ভালোভাবে শেষ করতে পারি। ব্যায়াম এবং হাঁটাহাঁটি আমাকে আরও সাহায্য করেছে। প্রতিদিন ৭-৮ কিলোমিটার হাঁটি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করি।

আমি চাই, আমার গল্প থেকে অন্যরা অনুপ্রেরণা পাক। ওজন কমানো কঠিন, কিন্তু তা ধরে রাখা আরও কঠিন। এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা এবং শৃঙ্খলার বিষয়।

তৌহিদ পারভেজ বিপ্লবের বর্তমান সময়ের ছবি
তৌহিদ পারভেজ বিপ্লবের বর্তমান সময়ের ছবি

শেষ কথা

আজ আমি ভালো আছি সুস্থ আছি। মোটা হওয়া একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমি জানি, ধৈর্য, শৃঙ্খলা এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সবকিছুই সম্ভব।

আমার যাত্রা প্রমাণ করে নিজের প্রতি আস্থা আর সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে জীবন বদলে যায়, সুন্দর হয়।

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫: ০০
বিজ্ঞাপন