সম্পদ: দুই বাংলার কারুকলা উৎসব
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কারুশিল্পের চমৎকার প্রদর্শনী। ‘সম্পদ’ শিরোনামের দুই বাংলার এই কারুকলা উৎসব ও প্রদর্শনীটির যৌথ আয়োজন ছিল রুরাল ক্রাফট অ্যান্ড কালচারাল হাব’স অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও অন্যান্য অতিথি
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও অন্যান্য অতিথি

এই উৎসবের সূচনার দিনে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে, বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ–আইসিএইচ) অনলাইন জাতীয় ইনভেন্ট্রির উদ্বোধন করা হয়। আমাদের দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য বিমূর্ত সাংস্কৃতিক উপাদানের ভান্ডার; যা প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে লালিত হয়েছে। এই ঐতিহ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বাংলাদেশ ২০০৯ সালে আইসিএইচ সুরক্ষার জন্য ‘ইউনেস্কো কনভেনশন ২০০৩’–স্বাক্ষর করে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনলাইন জাতীয় ইনভেন্ট্রি তৈরি লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হলো। একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হলো ‘দুই বাংলার কারুকলা উৎসব’। এই উৎসবে অংশ নেন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কারুশিল্পীরা। প্রদর্শনীতে স্থায় পায় পটচিত্রশিল্প, ডোকরা শিল্প, শোলাশিল্প, পাটিশিল্প ও নকশিকাঁথা।

বিজ্ঞাপন

ডোকরা মূলত বাঁকুড়া বিশেষ কারুশিল্প। এটা ধাতুশিল্পের (পিতল) মধ্যে পড়ে। তবে অন্যগুলোতে উভয় দেশের একজন করে কারুশিল্পী অংশ নিলেও বাংলাদেশের কোনো ধাতুশিল্পী অংশ নেননি। এই প্রদর্শনীতে আরও স্থান পায় ছৌ নাচের মুখোশ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি, এ ছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় জাদুঘরের সচিব গাজী মো. ওয়ালি–উল–হক, সংস্কৃতিসচিব খলিল আহমেদ, ইউনেসকো ঢাকা অফিসের অফিসার ইনচার্জ সুজান ভাইজ, আইসিএইচ–বিশেষজ্ঞ লবুনা মরিয়ম, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠান বাংলানাটকডটকমের পরিচালক মধুরা দত্ত ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. কামরুজ্জামান।

নকশি কাঁথা নিয়ে সেমিনারে অতিথিরা
নকশি কাঁথা নিয়ে সেমিনারে অতিথিরা

সমাপনী দিন সকালে অনুষ্ঠিত হয় শোলাশিল্পের ওপর কর্মশালা। এতে চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের দুজন শোলাশিল্পী ও মানস আচার্য্য এ সম্পর্কে বলেন। এছাড়া শিল্পীরা হাতে–কলমে শেখানোর চেষ্টা করেন। বিকেলে ছিল ছৌ কর্মশালা ও ছৌ পালা। সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক।

কেবল শেষের দিন নয়, প্রতিদিনই অনুষ্ঠিত হয়েছে কর্মশালা ও সেমিনার।  

বিজ্ঞাপন

পটচিত্র

বাংলার গ্রামীণ কারুশিল্পের এক অনন্য শিল্পকর্ম হচ্ছে পটচিত্র। সাধারণত সুতি কাপড়ের ওপর বিশেষ ধরনের প্রলেপ দিয়ে বর্ণনামূলক কাহিনি তুলে ধরার জন্য যে ছবি আঁকা হয়, তা–ই পটচিত্র নামে পরিচিত। তুলির সাহায্যে পটের ওপর নানান রঙের ছোঁয়ায় বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি বা রূপকল্প ফুটিয়ে তোলাই এই পটচিত্রের মূল কথা। প্রদর্শনীতে ‘গল্প যখন পটে’—শিরোনামের স্টলে রাজশাহীর পটচিত্রশিল্পী রতন কুমার প্রদর্শন করেন ক্যানভাস কাপড়ের পট, লক্ষ্মীসরা, বাঁশসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর লোকজ দৃশ্য ও মোটিভসহ গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, নারী, বন্ধু, নারীর চুল বাঁধার দৃশ্য ইত্যাদি। তিনি ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের পাশাপাশি নিজস্ব ধরনে পটচিত্র তৈরি করছেন ।

অন্যদিকে ‘ছবিতে গল্প’ শিরোনামে স্টল ছিল পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার পটচিত্রশিল্পী পম্পা চিত্রকরের। ১৫ বছর ধরে পটচিত্র আঁকছেন তিনি। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতন প্রদর্শনীতে অংশ নিতে পেরে বেশ খুশি পম্পা। সংস্কৃত শব্দ ‘পট্ট’ শব্দ থেকে এসেছে পট। এর অর্থ কাপড়, চিত্র বা ছবি। পটচিত্রে একটি গল্পকে লম্বা কাগজের ওপর একেকটি ফ্রেমে আঁকা হয় এবং পটচিত্রটিকে গুটিয়ে রাখা হয়। এই গোটানো পট খুলে ছবি দেখা হয় এবং গল্পটা বলা হয় গানের মধ্য দিয়ে। এ গানগুলোই হলো পটের গান। পটচিত্র পরিচিত গাঢ় ও উজ্জ্বল রং ও রেখার জন্য।

প্রাচীন ধাতুশিল্প ডোকরা

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলা থেকে ডোকরার নানা পণ্য প্রদর্শন করেন সোমনাথ কর্মকার। তাঁর গল্পে উঠে আসে ডোকরা পণ্যের গল্প। ডোকরা মূলত মানবসভ্যতার একেবারে আদি পর্বের এক লৌহবিহীন ধাতু ঢালাই–পদ্ধতি লস্ট ওয়াক্স–পদ্ধতিতে এই ধাতু ঢালাই করা হয়। সিন্ধুসভ্যতার সময় থেকে চলে আসা এক আদিম কৌশল এটি। আদিম সারল্য আর মনভোলানো লৌকিক নকশার এই মূর্তিগুলোয় মিশে আছে একধরণের গ্রাম্যতা ও প্রাচীনতা। ডোকরার কাজগুলোর পেছনে রয়েছে ধাতু ঢালাইয়ের এক কঠিনপ্রক্রিয়া। সোমনাথ কর্মকার বললেন, ডোকরা তৈরির জন্য বানানো ছাঁচ একবারই মাত্র ব্যবহার করা হয়। এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে তাঁর তৈরি করা ডোকরার নানা শোপিস ও গয়না।

কাঁথাশিল্প

ঐতিহ্যবাহী এই সূচিশিল্পে গ্রামীণ নারীরা ব্যবহৃত পুরোনো কাপড় দিয়ে নতুন এবং সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম জিনিস তৈরি করেন। ঐতিহ্যগতভাবে কাঁথা সেলাই করা হতো অবসর সময়ে। বর্তমানে কাঁথা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

আমিনার কাঁথা দেখছেন মন্ত্রী ও অন্যন্যরা
আমিনার কাঁথা দেখছেন মন্ত্রী ও অন্যন্যরা

‘বাহারি ফোঁড়ের গল্পকথা’ ছিল আমিনা ইয়াসমিনের স্টল। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার নানুর থেকে এসেছেন তিনি। ১০ বছর বয়স থেকে মা ও নানির কাছে নকশিকাঁথা তৈরি শেখার শুরু। সেই থেকে তিনি এ কাজ করছেন। এই কাজ করে অন্ধ স্বামীকে দেখছেন আর লেখপড়া শেখাচ্ছেন দুই ছেলেকে। তিনি নিয়ে এসেছিলেন কাঁথাস্টিচের শাড়ি, বিছানার চাদর, শাল ও ব্লাউজের পিস ইত্যাদি।

পাশের স্টলেই বাংলাদেশের নকশিকাঁথার সম্ভার নিয়ে বসেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর নকশিকাঁথার শিল্পী হোসনে আরা।

শোলাশিল্প

মাগুরার শোলাশিল্পী নিখিল চন্দ্র মালাকার
মাগুরার শোলাশিল্পী নিখিল চন্দ্র মালাকার

‘শুভ্রতায় নান্দনিকতা’ শিরোনামে শোলা থেকে তৈরি নানা ধরনের পণ্যের সম্ভার নিয়ে উপস্থিত ছিলেন মাগুরার নিখিল চন্দ্র মালাকার। উত্তরাধিকার সূত্রেই তিনি এ কাজে দক্ষ। ১০ বছর বয়সে বাবা ও কাকার কাছ থেকে শোলাশিল্পে হাতেখড়ির পর থেকে এ শিল্প তাঁর নেশা ও পেশা। নিখিল শোলা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফুল, লক্ষ্মীপূজার ফুল, পাখি, ঘর সাজানোর জিনিস, পাখা, কালীপূজার গলার মালা প্রভৃতি করে থাকেন। এই শিল্পকর্ম তৈরির জন্য তেমন কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। একটি ধারালো ছুরি ও একখণ্ড পাথর বা কাঠই যথেষ্ট। বাংলাদেশের ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, যশোর, মাগুরা, দিনাজপুর ও বরিশাল অঞ্চল শোলাশিল্পের জন্য বিখ্যাত।

পশ্চিমবঙ্গের শোলাশিল্পী সমীর কুমার সাহা
পশ্চিমবঙ্গের শোলাশিল্পী সমীর কুমার সাহা

‘অলংকরণের ঐতিহ্যবাহী শিল্প’ এই ছিল পশ্চিমবঙ্গের শোলাশিল্পী সমীর কুমার সাহার স্টলের শিরোনাম। অসাধারণ সব পণ্য নিয়ে বসেছিলেন তিনি। ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পী ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন। শোলা দিয়ে প্রতিমা ও প্রতিমার অলংকার, টোপর, সাজানো নৌকা, হাতি ইত্যাদি তৈরি করেন তিনি।

মাদুরবয়নশিল্প

মৌলভীবাজারের হরেন্দ্র কুমার দাশ
মৌলভীবাজারের হরেন্দ্র কুমার দাশ

‘বুননশৈলী’ শিরোনামে শীতলপাটির সম্ভার নিয়ে এসেছিলেন মৌলভীবাজারের হরেন্দ্র কুমার দাশ। ষোলো-সতেরো বছর বয়স থেকে বাবা–দাদার সঙ্গে শীতলপাটি বুননের কাজ জড়িয়ে পড়েন তিনি। বর্তমানে পাটি বুনেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। শীতলপাটি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, পাটি বা মাদুর বাংলাদেশের একটি বিশেষ বয়নশিল্প। মুর্তা, নল, বেত, বাঁশ হল পাটি তৈরির মূল উপকরণ। বুননের কৌশল ও বৈচিত্র্যেই তৈরি হয় শীতলপাটির নকশা বা কারুকার্য। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় কম-বেশি শীতলপাটি তৈরি হয়। তবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের পাটির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে সুখ্যাতি রয়েছে।

মেদিনীপুরের বাসিন্দা তাপস জানা
মেদিনীপুরের বাসিন্দা তাপস জানা

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের তাপস জানা ছোটবেলা থেকেই মসলন্দ এবং মাদুরকাঠি বুননের সঙ্গে জড়িত। খুব দক্ষতার সঙ্গে সূক্ষ্ম বুননকৌশলে তিনি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। ‘ঐতিহ্যবাহী কাঠির বুনন’ এই শিরোনামে তিনি স্টল সাজান মাদুরে। তিনি জানান, মাদুরের মূল উপকরণ দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতেরি জলাজমিতে জন্মানো মাদুরকাঠি নামে পরিচিত ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। অপরিবাহী এবং ঘাম শুষে নেয় বলে আর্দ্র আবহাওয়ার জায়গাগুলোতে মাদুর ব্যবহারের চল রয়েছে। মেঝেতে পাতা ছাড়াও নানা প্রয়োজন ও অলংকরণের কাজে মাদুর ব্যবহৃত হয়।

ছবি: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও হাল ফ্যাশন

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ০০
বিজ্ঞাপন