সন্তানহারা বাবা-মায়েদের জন্য এখন আমরা কী করতে পারি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ঢাকার উত্তরায় কাল ২২ জুলাই মাইলস্টোন স্কুলে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ছোট ছোট শিশুদের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুতে স্তব্ধ পুরো দেশ। বিভিন্ন হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে কচি প্রাণগুলো। আমরা সবাই হতবিহ্বল। একবার ভেবে দেখুন সেই সব বাবা-মায়ের কথা, যারা স্কুল ছুটির সময় এমন মর্মান্তিকভাবে সন্তান হারালেন। বলা হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের অভিজ্ঞতা হলো পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ। আর মায়ের কাছে সন্তান যে কী তা বলে বোঝানোও কঠিন। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হলেও কারও না কারও জীবনে এই দুর্বিষহ ঘটনা ঘটে যায়।

 কঠিন বাস্তবতা হলেও কারও না কারও জীবনে এই দুর্বিষহ ঘটনা ঘটে যায়
কঠিন বাস্তবতা হলেও কারও না কারও জীবনে এই দুর্বিষহ ঘটনা ঘটে যায়

সন্তান হারানোর দুঃখ কেবল একজন মা–বাবার জন্য নয়, এটি একটি কঠিন অভিজ্ঞতা, যা পুরো পরিবারকে, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী তথা সমাজকেও বিপর্যস্ত করে তোলে। প্রিয়জনের মৃত্যু মানসিক ও শারীরিকভাবে মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। এত আদরের সাত রাজার ধন হারানোর শোকের কারণে দীর্ঘমেয়াদি ট্রমায় আক্রান্ত হয় বাবা-মায়েদের নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

প্রিয়জন হারানোর পর শরীরে স্ট্রেস হরমোন কোর্টিসলের নিঃসরণ বেড়ে যায়। ডোপামিন ও সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যায়। ফলে মা–বাবা বারবার একই বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকেন। মস্তিষ্কের এমিগডালা অংশটি আবেগের প্রক্রিয়াকরণের জন্য দায়ী। সন্তান হারানো মা–বাবার শোকের ফলে এমিগডালার সক্রিয়তা বেড়ে যায়, যা মানসিক  চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি করে। এতে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মানসিক টানাপোড়েনের কারণে অনেকেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না, যা দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

প্রিয়জন হারানোর পর শরীরে স্ট্রেস হরমোন কোর্টিসলের নিঃসরণ বেড়ে যায়
প্রিয়জন হারানোর পর শরীরে স্ট্রেস হরমোন কোর্টিসলের নিঃসরণ বেড়ে যায়


কিছু মা–বাবা আছেন, যাঁদের সন্তান জন্মের পর থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং বদলে যায় মা–বাবার পথচলার স্বাভাবিক গতিপথ। যখন একটি শিশু জন্ম থেকে অসুস্থ হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে গুরুতর সমস্যায় ভোগে, তখন মা–বাবাকে এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে হয়। এই অবস্থায় শোকপ্রক্রিয়া শুরু হয় একেবারে শুরু থেকেই, কারণ মা–বাবা তাঁদের শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা আগে থেকেই অনুভব করেন। তাঁরা প্রতি মুহূর্তে সদা সতর্ক হয়ে থাকেন, যা মানসিক ও শারীরিক চাপের সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদি অসুখের শিকার শিশুদের বাবা-মায়েরা অনেক সময় নিজেদের আবেগের নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখে যান এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা সন্তান হারানোর পর পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল আয়ত্ত করতে চেষ্টা করেন।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে সন্তানের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা বাবা-মায়েদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হয়ে আসে। এটি তাঁদের জন্য একটি বিস্ফোরক ঘটনা। একমুহূর্তে সবকিছু শেষ হয়ে যায়—এ রকম অনুভূতি তাঁদের মধ্যে তৈরি হয়। এই অভিজ্ঞতা শোকের প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করবে, এক সেকেন্ডের মধ্যে তাঁদের জীবন উথালপাতাল হয়ে যায়। মা–বাবা বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করেন, কিন্তু বুঝতে পারেন না, মানার চেষ্টা করেন; কিন্তু মানতে পারেন না। কোনো যুক্তিতর্ক কোনো কিছু কাজে আসে না। মা–বাবা সম্পূর্ণ সময় সংগ্রাম করে যান। অনেক সময় তাঁরা নিজেদের আঘাত করেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

সন্তানের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা বাবা-মায়েদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হয়ে আসে
সন্তানের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা বাবা-মায়েদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হয়ে আসে

যাঁরা সন্তানহারা মা–বাবাকে সান্ত্বনা দিতে আসেন, তাঁরা নিজের অজান্তেই এমন কিছু কথা বলেন, যা মা–বাবাকে আরও বেশি কষ্ট দেয়। তাই মা–বাবাকে স্পেস দিতে হবে এবং কোনো ধরনের উপদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ,তাঁরা যা হারিয়েছেন, তা যে কোনো যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে। আপনার কোনো শব্দের চেয়ে শুধু আপনার নিস্তব্ধতা ওই মা–বাবাকে বেশি সাহায্য করবে। কিছু কিছু সময় শব্দের চেয়ে নিঃশব্দ বেশি উপকার করে। যেসব মা–বাবার আরও সন্তান থাকে, তারা অনন্যোপায় হয়ে কিছুটা হলেও সাংসারিক কাজকর্ম করতে থাকে। কিন্তু যাঁদের একটি বা দুটিমাত্র সন্তান, তাঁদের জন্য এটি খুবই কঠিন যাত্রা। এবারের ভয়ংকর দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিন শিশু মারা গিয়েছে। আরেক পরিবারের দুটি শিশুই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে দগ্ধ হয়ে।এই কষ্ট বলে বোঝানোর নয়। আপনার আশেপাশে এমন মা-বাবাদের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হোন, তাঁদের খোঁজ রাখুন। পরবর্তীতে তাঁদেরকে কোনো থেরাপিস্ট বা কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে গিয়ে কথা বলুন, সাহায্য নিন। এখন এই মুহূর্তে তাঁদের পাশে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের। তবে আমরা যেন অতি উৎসাহী বা অসংবেদনশীল না হই, সে ব্যাপারে খুবই সচেতন থাকতে হবে।

লেখক: ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৫, ০৬: ২২
বিজ্ঞাপন