আলোর মৃত্যু নেই
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ফ্রান্সের শিক্ষামন্ত্রী গুস্তাভ রোল্যান্ডকে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এমন অদ্ভুদ কাণ্ড বা এমন উটকো ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়নি। তাই তিনি স্বাক্ষর না করে, ফাইলটি ছয় মাস ধরে একপাশে ফেলে রেখেছেন। তাঁর ওপর চাপ বাড়ছে। দেশের মারমুখী রক্ষণশীলেরা একদম বেঁকে বসেছেন, দল বেঁধে তাঁরা তাঁদের মনের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে, নারীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এতে করে দেশ ও সমাজ উচ্ছন্নে যাবে। তাই স্বাক্ষর করা ঠিক হবে না। আর প্রগতিশীল, উদারপন্থী মহলগুলো তত দিনে সর্বত্র তাঁদের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলেন। তাঁরা রীতিমতো সরকারের এমন গড়িমসিতে সমালোচনায় কঠোর হলেন। দেশব্যাপী এ নিয়ে তুমুল আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক–বিতর্কের ঝড় উঠলে, শিক্ষামন্ত্রী সরকারের একজন ঝানু এবং অভিজ্ঞ মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না।

ফ্রান্সের নারী জাগরণের পথিকৃৎ এই মহীয়সী নারীকে একান্ত শ্রদ্ধায় স্মরণ করে ডাকবিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে
ফ্রান্সের নারী জাগরণের পথিকৃৎ এই মহীয়সী নারীকে একান্ত শ্রদ্ধায় স্মরণ করে ডাকবিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে
ছবি: ফরাসি ডাক বিভাগ

অবশেষ সম্রাজ্ঞী ইউজেনির সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষামন্ত্রী বাধ্য হয়ে, অনেকটা অনিচ্ছায় তরুণ নারী, জুলি-ভিক্তোয়া ডোবিয়ের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণের সনদে স্বাক্ষর করলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৬১ সালের ১৭ আগস্ট, ফ্রান্সে।
সেদিন জুলি-ভিক্তোয়া ডোবিয়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এর আগে কোনো ফরাসি নারী এই দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হতে পারেননি। অর্থাৎ জুলি হলেন প্রথম ফরাসি নারী, যিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং উচ্চমাধ্যমিকের চৌকাঠ অতিক্রম করতে সক্ষম হন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৭ বছর। জন্ম ১৮২৪ সালের ২৬ মার্চ।

বিজ্ঞাপন

এর আগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর, উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হতে চাইলে, প্যারিস এবং এইক্স শিক্ষা পর্ষদ থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে বলা হয়, নারীদের জন্য সে সুযোগ নেই। অথচ নারীদের শিক্ষা গ্রহণে আইনগত কোনো বাধা নেই। পরে তিনি অনেক চেষ্টা করে লিওঁ  শিক্ষা পর্ষদকে রাজি করতে সমর্থ হন। তবে শিক্ষা পর্ষদ থেকে তাঁকে জানানো হয় যে নারীদের জন্য শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই বলে, তাঁকে নিজের চেষ্টায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। শিক্ষার আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করার একান্ত অভিপ্রায়ে তিনি তাতেই সম্মত হন।

প্যারিসের ১৩ নম্বর মহল্লায়, একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে জুলি-ভিক্তোয়া ডোবিয়ের নামে
প্যারিসের ১৩ নম্বর মহল্লায়, একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে জুলি-ভিক্তোয়া ডোবিয়ের নামে
ছবি: উইকিপিডিয়া

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তিনি ছিলেন ৮ ভাই–বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। তাঁর এক ভাই ছিলেন গির্জার পাদরি। তাঁর কাছে খুব অল্প বয়সেই শিখেছিলেন গ্রিক ও লাতিন ভাষা। এরপর তিনি প্যারিসের জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাসের জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে অনেক বলেকয়ে সেখানে অধ্যয়নের অনুমতি লাভ করেন। তবে শর্ত একটাই—যখন এই জাদুঘর শিক্ষার্থী এবং দর্শকদের জন্য বন্ধ থাকবে, তখন তিনি এর পাঠাগার ও গবেষণাগার ব্যবহার করতে পারবেন। বাড়তি কোনো সুযোগ–সুবিধা থাকবে না। তিনি তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। অন্য সবাই যখন পাঠাগার ও গবেষণাগার ছেড়ে চলে গেছেন, তখন তিনি নিবিষ্ট চিত্তে মগ্ন হতেন জ্ঞান আহরণে।  

বিজ্ঞাপন

তবে সমস্যা দেখা দেয় পরীক্ষার সময়ে। নারীদের পরীক্ষা দেওয়ার আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। কর্তৃপক্ষ অবশেষে তাঁর একার জন্য একটি কক্ষের ব্যবস্থা করেন। সব পরীক্ষক পুরুষ হলেও, পরীক্ষায় তাঁকে তাঁর প্রাপ্য নম্বর দিতে হয়েছিল। বহু প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেও তিনি বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই চাঞ্চল্যকর সংবাদ বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়, সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনামে স্পষ্ট করে লেখা হয় ‘প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায় বলীয়ান হয়ে মাদমোয়াজেল ডোবিয়ে নারীদের জন্য আলোর নতুন পথ উম্মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন’।  
ডোবিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও, তাঁকে পুরুষদের সঙ্গে বসে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনেক বিপত্তি সত্ত্বেও ১৮৭১ সালের ২৮ অক্টোবর সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী প্রথম নারী হয়ে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেন।  

নিজের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে তিনি তৎকালীন নারী শিক্ষা বিষয়ে বেশ কিছু বই লেখেন। সেই সঙ্গে তাঁর একান্ত ইচ্ছা ছিল ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের। ইতিমধ্যে তাঁর ফুসফুসে বাসা বাঁধে রাজরোগ, মরণব্যাধি যক্ষা। ১৮৭৪ সালের ২৬ আগস্ট মাত্র ৫০ বছর বয়সে তাঁর বর্ণাঢ্য এবং সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটে। তাঁর শেষ ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি।

জুলি-ভিক্তোয়া ডোবিয়ের নামে রয়েছে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থাপনা
জুলি-ভিক্তোয়া ডোবিয়ের নামে রয়েছে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থাপনা
ছবি: সংগৃহীত

ফ্রান্সের নারী জাগরণের পথিকৃৎ এই মহীয়সী নারীকে একান্ত শ্রদ্ধায় স্মরণ করে ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। তাঁর নামে রয়েছে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থাপনা। তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে গেলেও, তাঁর রেখে যাওয়া আলো আলোকিত করেছে এবং আজও করে চলছে ফরাসি সমাজকে। আলোর মৃত্যু নেই।  

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ০০
বিজ্ঞাপন