পৃথিবীর দেশে দেশে দুর্গাপূজা: প্রবাসী বাঙালির বিশেষ উৎসব
শেয়ার করুন
ফলো করুন

দুর্গাপূজা শুধু উৎসব নয়, সংস্কৃতি, ভক্তি আর কমিউনিটির সংযোগের উপলক্ষও। নিউইয়র্ক কিংবা লন্ডন, সিডনি কিংবা সিঙ্গাপুর—প্রবাসী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মেতে ওঠেন এই মহা উৎসবে। লন্ডনের চমৎকার প্যান্ডেল, টরন্টোর ঢাকের তাল বা সিডনির স্থানীয় আবহ—সব জায়গায় পূজা পায় নতুন মাত্রা। চিরন্তন এই উৎসব মানুষকে বেঁধে রেখেছে একসূত্রে।

প্রবাসী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটা তাঁদের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের সংযোগসেতু। প্রতিবছর এই সময়, পৃথিবীর নানা শহরের কমিউনিটির মানুষ এক হয়ে প্যান্ডেল সাজান, ঢাকের তালে নাচে, নতুন পোশাক আর খাবারের নিজেদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে উদ্‌যাপন করেন। স্থানীয়রাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়।  ফলে দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে এক বৈশ্বিক উৎসব, যা শুধু স্মৃতি নয়, সম্পর্ককেও আরও মজবুত করে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরেই হয় পূজা
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরেই হয় পূজা

যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে নিউইয়র্ক, শিকাগো, হিউস্টন আর সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়ায় দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, প্রবাসী বাঙালিদের সম্প্রীতি–মিলনের প্রতীক। পূজা কমিটি ও সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো দিনরাত কাজ করে, যেন বাড়ির মতো অনুভূতি আনা যায়—সাজানো হয় প্যান্ডেল, আনা হয় দুর্গামূর্তি (ভারত থেকে বা স্থানীয়ভাবে তৈরি)। এই কেবল পূজা আচরিক নয়, বরং নাচ, গান, নাটক, সিনেমার প্রদর্শনী ও সাহিত্য আলোচনার মাধ্যমে কমিউনিটির মানুষকে সংযুক্ত রাখে। পরিবারের সবাই মিলে এসব আয়োজন করেন; স্বেচ্ছাসেবকেরা  প্যান্ডেল বানানো থেকে ভোগের খাবার তৈরি পর্যন্ত সব সামলান। তবে প্রথাগত রীতি মেনেই, এখানে স্থানীয় ঐতিহ্যও অনুসরণ করা হয়— ইন্ডিয়ান-আমেরিকান ফিউশন ফুড, মিক্সড স্টাইলের মঞ্চ পারফরম্যান্স আর পশ্চিমা ও ভারতীয় নৃত্যের সংমিশ্রণ। নিউইয়র্ক এবং বে এরিয়ার মতো শহরগুলোতে এই পূজা  হয়ে ওঠে এক বৈশ্বিক উৎসব, যা শুধু স্মৃতি নয়, প্রবাসীদের হৃদয়কেও আন্দোলিত করে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাজ্য

লন্ডনের পূজা
লন্ডনের পূজা
লন্ডনে হয় বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে
লন্ডনে হয় বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে

যুক্তরাজ্য বিশেষ করে লন্ডনে, দুর্গাপূজা উদ্‌যাপন হয় ভক্তি আর উচ্ছ্বাসে। ব্রিটিশ বাঙালি কমিউনিটি যুক্তরাজ্য বা কানাডার মতো বড় না হলেও উৎসবের আমেজ কোনো অংশে কম নয়। প্যান্ডেল সাজানো, মূর্তি স্থাপন (কিছু কলকাতা থেকে বানানো, কিছু স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি), রবীন্দ্রসংগীত, লোকনৃত্য ও আধুনিক পারফরম্যান্স—সব মিলিয়ে কমিউনিটি একত্র হয় বাঙালি ঐতিহ্য ও ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুন্দর মিশ্রণে। এখানকার পূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ রাখার সুযোগ, যেখানে স্থানীয়রাও অংশ নেয়, শেখে এবং উপভোগ করে। খাবারও এ উৎসবে বড় ভূমিকা রাখে— শর্ষে–ইলিশ, লুচি, মিষ্টি দই আর কমিউনিটি ফেস্টের ভোগ—সব মিলিয়ে যুক্তরাজ্যে দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে কালচারাল ফিউশন ফেস্টিভ্যাল, যা উচ্ছ্বাস আর ঐতিহ্যের অনন্য সংমিশ্রণ।

কানাডা

কানাডার একাধিক শহরে হয় পূজা
কানাডার একাধিক শহরে হয় পূজা

কানাডায় ঠিক আমেরিকার মতো, দুর্গাপূজা ক্রমেই বড় হচ্ছে প্রবাসী কমিউনিটির কারণে। টরন্টো, ভ্যাঙ্কুভার, মন্ট্রিয়ল আর ক্যালগেরির মতো শহরে প্রতিবার পূজা মানেই গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন—শীতের ঠান্ডা ভাঙে উষ্ণতার স্পর্শে; মানুষ একত্র হয়ে করে পরম্পরাগত পূজা, গান, নাচ এবং খাবারের আনন্দে মাতে। বড় কমিউনিটি সেন্টার বা রেন্টেড হলগুলোতে স্থাপিত হয় মূর্তি। পাশাপাশি চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, সংগীত ও নৃত্য। কানাডিয়ান বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে মিলে ইন্ডিয়ান-কানাডিয়ান ফিউশন তৈরি করে। খাবারেও মেলে ফিউশন—শর্ষে–ইলিশ, লুচি আর মিষ্টি দইয়ের সঙ্গে স্থানীয় উপকরণ ও কানাডিয়ান স্বাদ। টরন্টোর বাঙালিদের সংস্থা কালচারাল সোসাইটি অব টরন্টো, ভ্যাঙ্কুভার ও মন্ট্রিয়লের স্থানীয় অ্যাসোসিয়েশন প্রতিবার এই উৎসবকে কয়েক দিনের কমিউনিটি মেলা বানিয়ে সবার জন্য আনন্দ ও সংযোগের উপলক্ষ তৈরি করে।

অস্ট্রেলিয়া

সিডনির আয়োজন; আরও একাধিক শহরে হয় দুর্গাপূজা
সিডনির আয়োজন; আরও একাধিক শহরে হয় দুর্গাপূজা

সিডনি, মেলবোর্ন ও ব্রিসবেনে প্রবাসীরা দুর্গাপূজা উদ্‌যাপন করেন। যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতোই উচ্ছ্বাসের রঙে মেতে ওঠেন সবাই। আবহাওয়া যতই আলাদা হোক না কেন, উৎসবের মূল ভাব একই—পূজা, আরতি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর কমিউনিটি বন্ডিং। স্থানীয় বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনগুলো কলকাতা থেকে দুর্গার মূর্তি আনে, প্যান্ডেল সাজায় এবং সম্প্রদায়কে একত্র করে। রবীন্দ্রসংগীত, নাচ, নাটক—সবই থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। ছোটরা ও কিশোর-কিশোরীরা নিজের ট্যালেন্ট প্রদর্শন করে, যা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। পরিবারমুখী কার্যক্রমও থাকে—কিডস কম্পিটিশন, ফুড স্টল আর গেমস। সিডনিতে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ সাউথ ওয়েলস (বিএনএনএসডব্লিউ), মেলবোর্নের বাঙালি কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অব ভিক্টোরিয়ার (বিসিএভি) আয়োজনে পূজা হয় সাড়ম্বরে। থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর হরেক রকম খাবারের আয়োজন। এখানে যেন বাঙালি আর অবাঙালি সবাই উপভোগ করে উৎসব।

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া

সিঙ্গাপুরে দুর্গাপূজা
সিঙ্গাপুরে দুর্গাপূজা

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের কাছে দুর্গাপূজা যেন বহু সংস্কৃতির উৎসব। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় দুর্গাপূজা প্রবাসী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য সাড়ম্বর উদ্‌যাপনের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে, পূজা হয় আরও রঙিন এবং উৎসবমুখর। প্রবাসী বাঙালি সনাতনীরা ও স্থানীয় বাসিন্দারা একত্র হয়ে করেন পূজা, আরতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখানে প্যান্ডেলে দুর্গার মূর্তি স্থাপন করা হয়। প্রথাগতভাবে পূজা পরিচালনা করেন ভারত থেকে আসা পুরোহিতরা। বাঙালি স্বাদের সঙ্গী হয় মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের ঐতিহ্যবাহী পদ। সিঙ্গাপুরের বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন, কুয়ালালামপুর ও পেনাং—সব জায়গায় পূজা হয়ে ওঠে জমকালো। প্রবাসী কমিউনিটি এবং স্থানীয়দের একত্র করে এই উৎসব।

বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে প্রবাসী সনাতনীরা থাকুক, দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং কমিউনিটির এক অমোঘ সেতু। নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তাঘাট হোক বা সিঙ্গাপুরের মাল্টিকালচারাল পরিবেশ, প্রতিটি স্থানেই পূজা উদ্‌যাপন হয় ভক্তি, আনন্দ এবং একতার সঙ্গে। প্যান্ডেল সাজানো থেকে শুরু করে মিউজিক, নাচ, নাটক, খাবার এবং পরিবারমুখী কার্যক্রম—সবই প্রমাণ করে, এই উৎসব সীমান্ত ছাড়িয়ে মানুষের হৃদয়কে একত্র করতে সক্ষম। দুর্গাপূজা তাই শুধু স্মৃতি নয়, বরং প্রবাসী সনাতনীদের সংস্কৃতি ধরে রাখার এবং নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত রাখার একটি শক্তিশালী উৎসব।
সূত্র: এডিটোরিয়ালএজ

ছবি: বিভিন্ন ওয়েবসাইট, সামাজিক মাধ্যম

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ০৭
বিজ্ঞাপন