চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী পাঁচ প্রাচীন পূজামণ্ডপের নান্দনিক আয়োজন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পঞ্জিকা অনুসারে দেবীর আগমন ধরা হয় সপ্তমী তিথিতে। এবার সপ্তমী ছিল বৃহস্পতিবারে, তাই হিন্দু শাস্ত্রমতে দেবীর এসেছেন দোলা বা পালকিতে চড়ে। বিজয়া দশমীতে দেবী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন কৈলাসে। রোববার দশমী হওয়ায়, দেবী ফিরছেন হাতির পিঠে চড়ে।

আগমন ও  প্রস্থান বাহনের বিষয়টি মানুষের বিশ্বাস। প্রকৃতপক্ষে যার যার ভক্তি, ভাবনা ও নিবেদনের ওপরই নির্ভর করেছে মাতৃবন্দনায় কার কী প্রাপ্তি ঘটবে।

হিন্দু শাস্ত্রমতে, দোলায় আগমনের কারণে হতে পারে মহামারি, ভূমিকম্প, খরা, যুদ্ধ ও প্রাণহানি। আর হাতিতে গমনের কারণে পূর্ণ হতে পারে ভক্তদের মনের ইচ্ছা, সুফল মিলতে পারে পরিশ্রমের আর সুখ-সমৃদ্ধির দেখা পেতে পারেন মর্ত্যলোকের বাসিন্দারা।

বিজ্ঞাপন

হাজারী লেন

চট্টগ্রামে শহরে যে কয়টি প্রাচীন পূজামণ্ডপ আছে তার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী হাজারী লেনের পূজাটি অন্যতম। এখানকার পরিবেশ অনেকটা ঢাকার শাঁখারীবাজারের মতো। এখানে দুর্গাপূজা ছাড়া বছরে নানা পার্বণকে ঘিরে সব দেব–দেবীর পূজার আয়োজন করা হয়। পূজা কমিটির সভাপতি শিবপ্রসাদ দাস বলেন, ‘এবারের হাজারীর লেনের পূজা ১৫০ বছরে পদার্পণ করেছে।

ধর্মীয় শাস্ত্রীয় রীতি মেনে দেবীর রূপকে উপস্থাপন করা হয়েছে
ধর্মীয় শাস্ত্রীয় রীতি মেনে দেবীর রূপকে উপস্থাপন করা হয়েছে

নানা সময় আমরা বিভিন্ন থিমের ওপর পূজার আয়োজন করলেও এবার ধর্মীয় শাস্ত্রীয় রীতি মেনে মায়ের যে রূপ ঠিক সেভাবেই পূজার আয়োজন করেছি। এখানে সকাল থেকে গভীর রাত অবধি মানুষ পূজা দেখতে আসে। হাজারী লেনের সন্ধ্যা আরতি বিশেষ করে মেয়েদের ধুনচি নাচ প্রধান আকর্ষণ।’

এ ছাড়া তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক নারীকে যথাযথ সম্মান ও নিরাপত্তা দিতে পারলেই সব নারীর বিকাশ সম্ভব। প্রতি মায়ের মধ্যেই একটি প্রতিমা আছে। এই ভাবনা সবাইকে অন্তরে ধারণ করতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

দক্ষিণ নালাপাড়া

চট্টগ্রাম মহানগরীতে যে কয়টি পূজায় মানুষের আকর্ষণ থাকে তার মধ্যে দক্ষিণ নালাপাড়া সর্বজনীন পূজা পরিষদের আয়োজন অন্যতম। কয়েক বছর ধরে নানা থিমের ওপর পূজার আয়োজন করে আসছে তারা। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন কিছু পূজার আয়োজন দেখিয়ে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল দক্ষিণ নালাপাড়া পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ। ২০২২ সালে আদিবাসীদের পূজায় অংশগ্রহণ দেখাতে গিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের পূজামণ্ডপে উপস্থাপন করেছে সাবলীলভাবে।

বিশ্ব জুড়ে চলমান নানা অস্থিরতা দূর করার ভাবনায়  নবদুর্গার আদলে করা হয়েছে এবারের প্রতিমা
বিশ্ব জুড়ে চলমান নানা অস্থিরতা দূর করার ভাবনায় নবদুর্গার আদলে করা হয়েছে এবারের প্রতিমা

সেবার পূজার নাম দিয়েছিল পার্বণ। পূজা প্রতিযোগিতায় কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ নালাপাড়া প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। এবারের পূজা আয়োজন নিয়ে পূজা কমিটির নির্বাহী সদস্য রাজীব বিশ্বাস রাজা বলেন, ‘আমাদের এবারের পূজার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল কেবলই মাতৃ–আরাধনা। মাতৃ–আরাধনায় এবার মণ্ডপে সাজানো হয় মায়ের নয়টি রূপ, অর্থাৎ নবদুর্গা থিমে।’

নবদুর্গা মায়ের আলাদা আলাদা রূপ। তাই নবদুর্গা মাতৃ–আরাধনা করার কারণ বিশ্বের নানা প্রান্তে অশান্তি, যুদ্ধ, হত্যা, অতি প্লাবন, মহামারা, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা এসব দেখা দিচ্ছে প্রবলভাবে। সামাজিক অবক্ষয় ও মানুষরূপী অসুরের প্রবণতা বেড়ে গেছে সমাজে। সমাজের শান্তি বিনষ্টকারী অসুরদের দমানো এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মায়ের কাছে মাতৃ–আরাধনার মাধ্যমে প্রার্থনা করা হয়েছে। দক্ষিণ নালাপাড়া সর্বজনীন পূজা পরিষদ এবার আনুষ্ঠাকিভাবে ৭৭ বছরে পর্দাপণ করেছে, কিন্তু এই আয়োজন হয়ে আসছে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, জানান কমিটির নির্বাহী সদস্য রাজীব বিশ্বাস রাজা।

গোসাইলডাঙ্গা একতা গোষ্ঠী

‘তোমার দুর্গা মাটির তৈরি, সেজে ওঠে অলংকারে/ আমার দুর্গা মায়ের রূপে, ঠাঁই পায় না ঘরে’/ ‘আমার দুর্গা ঘরে সংসারে অক্লান্ত খেটে চলে/ আমার দুর্গা একটু কষ্টে ডাকে আয় খোকা বলে’/ ‘আমার দুর্গা কাস্তে হাতুড়ি, আউশ ধানের মাঠে/ আমার দুর্গা ত্রিশূল ধরেছে, স্বর্গে এবং মর্ত্যে’/ এবং ‘তোমার দুর্গা বহুজাতিকের বহুজনহিতায়চ, আমার দুর্গা কালকে যেমন, আজো তথৈবচ’—কবিতার পঙ্‌ক্তির সঙ্গে ছবির দৃশ্যায়নে সেজেছিল এই মণ্ডপ।

চট্টগ্রাম নগরী গোসাইলডাঙ্গা একতা গোষ্ঠীর পূজার আয়োজন এবার ১৩০তম। এবারের থিম ছিল ‘দুর্গা স্ব-রূপা’।

‘দুর্গা স্ব-রূপা’– এটাই ছিল তাদের ভাবনা
‘দুর্গা স্ব-রূপা’– এটাই ছিল তাদের ভাবনা

একতা গোষ্ঠী সর্বজনীন দুর্গোৎসবের কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও মঞ্চ ভাবনাকারী শিল্পী জয় দাশ বলেন, ‘আমাদের সবার ঘরেই একজন করে মা দুর্গা থাকেন। সন্তানের কাছে তার নিজের মা তো দেবী দুর্গাই।

প্রতিবারই চট্টগ্রামবাসী নতুন কিছু চায়। তাদের চাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবারও ছিল নতুন ভাবনা। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৫ দিন আমরা শুধু দেবী মায়ের পূজা করি। প্রতিটি ঘরেই আমরা সন্তানেরা মায়ের ওপর নির্ভরশীল। মায়ের মধ্যেই আমরা প্রতিদিন দেবী রূপকে খুঁজে পাই। একজন নারী পেশাজীবী বা গৃহিণী, তিনিই আবার কারও মা, কারও বোন, কারও সহধর্মিণী। কিন্তু এই মাতৃরূপা নারীকেই প্রতিদিন পথ চলতে নিরাপত্তার শঙ্কায় থাকতে হয়।’

ফিরিঙ্গিবাজার শ্মশানেশ্বর শিববিগ্রহ মন্দির

নগরীর অন্যতম পুরোনো পূজামণ্ডপ ফিরিঙ্গিবাজারের শ্মশানেশ্বর শিববিগ্রহ মন্দিরে এবার ৯৫তম মাতৃবন্দনা হয়েছে। তাদের এবারের ভাবনা ছিল, ‘ইতিহাস হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে, দেবতাদের স্থান হয় মনুষ্য জাদুঘরে।’

ইতিহাস হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে, দেবতাদের স্থান হয় মনুষ্য জাদুঘরে– চমৎকার এই থিম ছিল এখানকার প্রতিমার
ইতিহাস হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে, দেবতাদের স্থান হয় মনুষ্য জাদুঘরে– চমৎকার এই থিম ছিল এখানকার প্রতিমার

প্রতিমাশিল্পী রতন কৃষ্ণ পাল দেবী দুর্গাকে গড়েন পোড়ামাটির প্রতিমার আদলে। আরেক শিল্পী সৃজন দাশ মিঠুন মণ্ডপের দুপাশে থাকা অন্যান্য প্রতিমা গড়েন কষ্টিপাথরের মূর্তির আদলে।

এসব দেব–দেবীর মূর্তি আমাদের অতীত ইতিহাস। যারা অতীতকে উপেক্ষা করে তাদের কোনো বর্তমানও নেই, ভবিষ্যৎও নেই। এসব উদ্ধার হওয়া প্রতিমার স্থান হওয়া উচিত ছিল মন্দিরে আর মানুষের হৃদয়ে; তথা মনুষ্য জাদুঘরে। নতুন প্রজন্মকে সমৃদ্ধ ইতিহাস জানাতেই এই ভাবনা ঘিরে পূজার আয়োজন করে এই আয়োজকেরা।

পাথরঘাটা বংশাল রোডের পাঁচবাড়ি

চট্টগ্রামের পাথরঘাটা বংশাল রোডের ঐতিহ্যবাহী পাঁচবাড়ি পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ এবার প্রতিমা গড়ে ‘অসুর শক্তির বিনাশ’ ভাবনাকে ঘিরে। দেবী দুর্গার পদতলে মহিষাসুর। পেছনে মানুষরূপী ১৫টি অসুরের মূর্তি। রণভঙ্গিতে সশস্ত্র নীল বর্ণা অভয়দাত্রী দেবী; যেন এগিয়ে চলেছেন দৃপ্ত পায়ে। ‘মানুষরূপী’ অসুর দমনে রণভঙ্গিতে দেবী দুর্গা।

১৯৫০ সালে শুরু হওয়া এই পূজার বয়স এবার ৭৪ বছর। চট্টগ্রামে দুর্গাপূজায় ‘থিম’ প্রচলনকারী মণ্ডপগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান পাঁচবাড়ির এই মণ্ডপ।

এবারের প্রতিমা–ভাবনার বিষয়ে পাঁচবাড়ি পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি জয়জিৎ চৌধুরী বলেন, ‘সব সময়ের মতো মহিষাসুর তো আছেই। কিন্তু অসুর নানা রূপে থাকে আশপাশেই। মানুষরূপী অসুরের সংখ্যা এখন বেশি। মা দুর্গার পেছনে যাঁদের দেখছেন, তাঁরা সবাই মানুষরূপী অসুরের প্রতীক।


‘আর দেবী দুর্গা এবং গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী এবার নীল বর্ণের করা হয়। কারণ নীল রং হলো প্রজ্ঞা, নির্ভরযোগ্যতা, শান্তি, অনুপ্রেরণা ও স্থিতিশীলতার প্রতীক’, জানান তিনি।

দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আগমন ও প্রস্থানের সময় যে বাহন ব্যবহার করেন, এর ওপরে সারা বছর কেমন কাটবে তা নির্ভর করে বলে ভক্তকুলের বিশ্বাস শেষ হবে বিজয়া দশমীতে চোখের জলে মাতৃরূপী দেবী তথা কন্যা বিদায়ের মধ্য দিয়ে।

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯: ২০
বিজ্ঞাপন